অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে নগরে নবান্নের ছোঁয়া

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ১৬, ২০২২, ০৪:৫৯ পিএম

অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে নগরে নবান্নের ছোঁয়া

আজ নবান্ন উৎসব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পুরোভাগে থাকা এই নবান্ন উৎসব অনাদিকাল হতে বাঙালির জীবন অধিকার করে আছে। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে হয় নবান্ন উৎসব। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলছে আগাম আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়।

ফসল ঘরে তোলার আনন্দ প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়ও। ‘ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’ নবান্ন নিয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আয়োজন করা হয়েছে নবান্ন উৎসবের। গ্রামের মতো শহরেও, বিশেষ করে ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদযাপন শুরু হয়।

জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ প্রতি বছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে। বুধবার (১৬ নভেম্বর) ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে নবান্ন উৎসব ১৪২৯-এর আয়োজন করা হয়েছে।

সকাল সাড়ে সাতটায় শুরু হয় এ উৎসব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীতে ঘটা করে উদযাপন করা হচ্ছে নবান্ন উৎসব। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হতো এই উৎসব।

সকাল-বিকেল দুই পর্বে বিভক্ত ‘নবান্ন উৎসব’। আয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে গ্রামীণ নানা অনুষঙ্গ। তুলে ধরা হচ্ছে গান, নৃত্য ও কবিতার ভাষায় ফসলকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা।

সংস্কৃতিকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ অনেকেই জড়ো হয়েছেন শিল্পকলায়। নেচে গেয়ে লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছেন তারা। নানা পরিবেশনা ছাড়াও উৎসবে আগতদের জন্য আছে খই, মুড়ি, পিঠাপুলির ব্যবস্থা। ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে উৎসবে শহুরে মানুষের জটলায় জমজমাট হয়ে উঠেছে। শিল্পীদের কণ্ঠে কখনও একক, কখনো দলীয় গান। কখনও আবার গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্য। মাঝে কিছুটা বিরতি। বিকেল পাঁচটায় শুরু হবে নবান্ন উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব।

নবান্ন থেকে কৃষক ‘রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান’ কেটে আনে ঘরে। কুয়াশায় মোড়া প্রকৃতির ভেতর ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় হেমন্তের বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির মুখরতা নেই। তারপরও সেই আনন্দঘন পরিবেশ একবারে ম্লান হয়নি। এদিন নতুন চালের পিঠার জন্য শুরু করেন খেজুরের রস সংগ্রহ। নতুন রস আর নতুন চালের পিঠা হয়ে আছে বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

হিন্দু লোককথায় এদিনকে বলা হয়ে থাকে বাৎসরিক মাঙ্গলিক দিন। নতুন আমন চালের ভাত বিবিধ ব্যঞ্জনে অন্নাহার, পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মুখর হয় জনপদ। মেয়েকে নাইয়র আনা হয় বাপের বাড়ি। নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে কোথাও কোথাও দোয়া, মসজিদে শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। হিন্দু কৃষকের ঘরে পূজার আয়োজন চলে ধুমধামে। হিন্দুদের বারো মাসের তেরো পার্বণের বড় পার্বণ হলো এই নবান্ন। এই নবান্নকে ঘিরে তাদের বারো পূজার প্রচলন আছে। তারা নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক প্রভৃতি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন নবান্ন গ্রহণ করেন। হিন্দু লোকবিশ্বাসে কাকের মাধ্যমে ঐ খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। 

গবেষকরা বলছেন, কৃষিপ্রথা চালু হওয়ার পর থেকে নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। একসময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা বছরের পয়লা মাস। ‘অগ্র’ মানে ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। লৌকিক ইতিহাস জানাচ্ছে যে, অতীতে বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব পালন করত প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়। হেমন্তে আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ কিংবা পৌষ মাসে গৃহস্থরা এ উৎসব পালনে মেতে উঠত। হেমন্তে প্রকৃতির বিচিত্র রূপের বর্ণনা আর স্তুতিতে মুখর কবি-সাহিত্যিকরা। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে পুনর্বার ফিরে আসার আকুতি ধ্বনিত হয়েছে, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। হেমন্তের প্রকৃতিতে বিভোর কবি বর্ণনা করেছেন, ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল,/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/ পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’ 

Link copied!