আমলা নাকি রাজনীতিবিদ: কে হচ্ছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি?

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩, ০৫:২৪ পিএম

আমলা নাকি রাজনীতিবিদ: কে হচ্ছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি?

সংবিধান অনুসারে চলতি ফেব্রুয়ারিতেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা আছে। কেন না দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করায় তৃতীয় মেয়াদে আর ওই পদে থাকতে পারবেন না মো. আব্দুল হামিদ। এখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই পদে কে বসতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এই পদে এরইমধ্যে ডজনখানেক প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও তা এখন তিনটিতে নেমে এসেছে। 

আমলা থেকে শুরু করে কবি, লেখক, বিচারপতি, রাজনীতিবিদরা ছিলেন আলোচনায়। তবে বর্তমানে যে তিনজনের নাম শোনা যাচ্ছে তাঁরা হলেন, মসিউর রহমান, শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। 

সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। ফলে, যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন, তিনিই দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন—এটা নিশ্চিত বলা যায়। কেন না সংবিধান অনুসারে ফ্লোর ক্রসিংয়ের সুযোগ নেই সংসদ সদস্যদের।

শক্ত অর্থনীতির ভিত গড়তে আমলা?

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, নানা বিচার-বিশ্লেষণ করে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তালিকা ছোট করে এনেছেন। এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান সর্বোচ্চ বিবেচনায় আছেন।

চলমান বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দার মাঝেও বাংলাদেশ বেশ ভাল অবস্থানে আছে। বিডা, বেজাসহ বেশ কিছু বিষয় তাঁর তত্ত্বাবধায়নে হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু বৈদেশিক বিনিয়োগে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নীত করায় তাঁর অবদান আছে। তাই রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর নাম বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে।

তবে দলীয় সভাপতির ঘনিষ্ঠ মহলে সক্রিয় কোনো রাজনীতিককে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদে বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। এ ক্ষেত্রে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে বিবেচনায় রাখছেন দলের নীতিনির্ধারকদের অনেকে।

মসিউর রহমান স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব হন। এরপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ নানা দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করলে মসিউর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই তিনি এ দায়িত্বে আছেন। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদেরও সদস্য। বয়স, দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি থাকা এবং অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর সম্ভাবনাও দেখছেন দলের নেতারা।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সম্পাদকীয় বিভাগের উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যানর করা হয়েছে মসিউর রহমানকে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঠিক আগে তাঁকে দলের এই পদে দেওয়ার ফলে রাষ্ট্রপতি পদে তিনেই যে আসছেন, দলের কেউ কেউ সেটি মনে করছেন। অবশ্য আগেও মসিউর রহমান এই পদে ছিলেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাই উপকমিটির চেয়ারম্যান হন।

এবার কি নারী রাষ্ট্রপতি?

শিরীন শারমিন চোধুরী পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন— এমন কথা কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ চাউর হয়ে গেছে। ঘনিষ্ঠজন ও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ আগাম অভিনন্দনও জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দল থেকে নিশ্চিত সংবাদ না পাওয়ায় সামাজিক মাধ্যমের আলোচনা নিয়ে স্পিকার কিছুটা বিব্রতও বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় একজন নারীকে রাষ্ট্রপতি করার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে শিরীন শারমিন চৌধুরীই সম্ভাব্য সেরা প্রার্থী বলে মনে করছেন দলের নেতারা। এ ক্ষেত্রে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা এবং সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা—সবাই হবেন নারী। এমন অবস্থাকে দলের নেতারা বলছেন ‘চমকপ্রদ’। তবে ভবিষ্যতে সংসদ পরিচালনায় অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে ভেবে শিরীন শারমিন চৌধুরীকে স্পিকার পদে রেখে দেওয়া হতে পারে—এ সম্ভাবনাও জোরালো বলে দলের ভেতর আলোচনা আছে। এ ছাড়া তাঁর বয়স তুলনামূলক কম হওয়ায় কেউ কেউ এবার তাঁকে বিবেচনায় রাখতে চাইছেন না।

শক্ত অবস্থানে মোশাররফ হোসেন

পুরোদস্তুর রাজনীতিক হিসেবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে রাষ্ট্রপতি পদে ‘শক্তিশালী’ প্রার্থী বিবেচনা করছেন দলের অনেকে। ১৯৭০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন তিনি। এ পর্যন্ত ছয়বার আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন দলীয় প্রধানকে।

দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির পর তাঁকে রাষ্ট্রপতির সম্মান দেওয়া হতে পারে বলে মনে করছেন দলের নেতাদের কেউ কেউ। গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের যে নতুন কমিটি গঠন করা হয়, তাতে সভাপতিমণ্ডলীতে মোশাররফ হোসেনের নাম সভাপতির পরেই রাখা হয়েছে। এটাকেও কেউ কেউ রাষ্ট্রপতি পদে বিবেচনার ইঙ্গিত মনে করছেন। 

আলোচনায় ছিলেন যারা

রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের ভেতর কয়েক মাস ধরে ডজনের বেশি ব্যক্তির নাম আলোচনায় ছিল। এর মধ্যে শীর্ষে থাকা উপরের তিনজনের বাইরেও ছিলেন আনিসুল হক ও বিচারপতি খায়রুল হকও।

এছাড়া বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নুরুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দীক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আ ক ম মোজাম্মেল হকও ছিলেন আলোচনায়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন যেভাবে হয়

সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে ১৯৯১ সালের পর আর কখনো রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়ে আসছেন। 

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তফসিল অনুসারে, দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি। তবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী দেবে—এমন কোনো তৎপরতা বা আলোচনা নেই। ফলে, একক প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ পরিস্থিতিতে ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রার্থিতা যাচাই-বাছাইয়ের পরই আসলে নিশ্চিত হয়ে যাবে, কে হচ্ছেন বঙ্গভবনের পরবর্তী বাসিন্দা। তখন ভোটের আর প্রয়োজন পড়বে না।

রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে দলের একটি সংসদীয় বোর্ড আছে। এই বোর্ডের দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় সংসদসহ জাতীয় পর্যায়ের সব নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া। এই সংসদীয় বোর্ডে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী ঠিক করা হবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এরপর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংসদীয় দলের বৈঠকেও তা তোলা হতে পারে।

ঘোষিত তফসিল অনুসারে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নির্বাচনী কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগ্রহী প্রার্থীরা ১২ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। এ নির্বাচনে ভোটার সংসদ সদস্যরা। ভোটার ৩৪৩ জন সংসদ সদস্য।

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ মোট আসন ৩৫০টি। আওয়ামী লীগের মোট আসন ৩০২টি, জাতীয় পার্টির ২৬টি, ওয়ার্কার্স পার্টির ৪টি, জাসদের ২টি, গণফোরামের ২টি, বিকল্পধারার ২টি, তরিকত ফেডারেশনের ১টি ও জেপির ১টি আসন রয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রয়েছেন তিনজন।

সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ অবসানের কারণে এ পদ শূন্য হলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে শূন্য পদ পূরণের জন্য নির্বাচন হবে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মো. আবদুল হামিদ। আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হবে তাঁর মেয়াদ। সংবিধান অনুযায়ী, ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে।

রাষ্ট্রপতির কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তাই অনেকেই পদটিকে ‘আলংকারিক’ হিসেবে আখ্যা দেন। তবে রাজনৈতিক সংকট কিংবা নির্বাচনের সময়ে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। সে কারণে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা

সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করবেন। সংবিধান ও অন্য কোনো আইনের দ্বারা তাঁকে দেওয়া ও অর্পিত সব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করবেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত রাখবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য পেশ করবেন প্রধানমন্ত্রী।

এ থেকে মনে হতে পারে, রাষ্ট্রপতি অগাধ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু আদতে তা নয়। সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বলা হয়েছে, শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কারও পরামর্শ নেওয়ার দরকার নেই। বাকি সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।

এর সাথে সংবিধান শর্তও জুড়ে দিয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কি না কিংবা পরামর্শ দিয়ে থাকলে সেটা সম্পর্কে কোনো আদালত প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। পদটি আলংকারিক হলেও একজন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোট লাগে। ভোটের আগে আলোচনা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের একমত হতে হবে যে রাষ্ট্রপতি আইন ভেঙেছেন।

Link copied!