ইউক্রেন নিয়ে আসলে কী করতে চান পুতিন

ড্যানিয়েল উইলিয়ামস

ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২, ১১:১২ পিএম

ইউক্রেন নিয়ে আসলে কী করতে চান পুতিন

রাশিয়া যদি শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে সেনা ঢুকিয়ে দেয় (ইতিমধ্যে রুশ সেনারা ইউক্রেনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখল করে সেখানে অবস্থান করছে), তাহলে দেশটির বিরুদ্ধে আর্থিক নাকি কূটনৈতিক কায়দায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে— সে সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র জোট ন্যাটো ঠিক করে উঠতে পারেনি। তার আগেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের মাটিতে ট্যাংক ঢোকানোর নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন। (ইতিমধ্যে কিয়েভে রুশ ক্ষেপনাস্ত্রগুলো আঘাতও হেনেছে।)

সোমবার রাশিয়ার পার্লামেন্ট পুতিনকে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক—ইউক্রেনভুক্ত এই দুটি ভূখণ্ডকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানানোর পর পুতিন তাতে ‘সানন্দে সায় দিয়েছেন’। এমনিতে আগে থেকেই এই দুই এলাকায় ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা রুশ মিলিশিয়াদের ক্রেমলিন সমর্থণ দিয়ে আসছিল। সোমবার পুতিন একেবারে সশরীর রুশ সেনাদের সেখানে ঢুকে ‘শান্তি রক্ষা করতে’ নির্দেশ দিয়েছেন। পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের সেনাদের ছোড়া গোলা রুশপন্থী এলাকার একটি স্কুলে আঘাত করেছে; রাশিয়াপন্থী বহু নারী ও শিশুকে উদ্ধার করে বাসে করে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অবশ্য ইউক্রেন সরকার সম্পর্কে পুতিনের এমন কথা বিশ্বাস করেন এমন লোক পাওয়া কঠিন। কারণ, সবাই জানে, রাশিয়া প্রায় দেড় লাখ সেনা দিয়ে তিন দিক থেকে ইউক্রেনকে ঘিরে রেখেছে। ট্যাংক, রকেট এবং জঙ্গি বিমান—এই বিশাল বাহিনীর সঙ্গে আছে। রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিলেও খুব কম লোকই ক্রিমিয়া দখল নিয়ে কথা বলছে। ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগর উপকূলে পুতিনের যুদ্ধজাহাজগুলো টহল দিচ্ছে। সব মিলিয়ে পুতিনের আসল লক্ষ্য কী, সেটিই এখন বড় জিজ্ঞাস্য হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসীর।

পুতিনের আসল লক্ষ্য কী— সেটি শক্ত প্রশ্ন হলেও তার আপাতত লক্ষ্যটা অনেকটাই খোলাসা। আর সেটি হলো, তিনি প্রথমত ও প্রধানত চান ইউক্রেন কস্মিনকালেও ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। এমনকি পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের মাখামাখি হোক, তা–ও তিনি চান না। তিনি যা চান তা হল, যে কোনো মূল্যে পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউক্রেনের গলায়-গলায় খাতির জমানোর চেষ্টাকে নস্যাৎ করা।

পুতিনের আসল লক্ষ্য কী—সেটি শক্ত প্রশ্ন হলেও তার আপাতত লক্ষ্যটা পরিষ্কার। সেটি হলো তিনি প্রথমত ও প্রধানত চান ইউক্রেন কস্মিনকালেও ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। এমনকি পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হোক, তা–ও তিনি চান না। তিনি চান, যেকোনো মূল্যে পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউক্রেনের গলায়-গলায় খাতির জমানোর চেষ্টাকে নস্যাৎ করতে হবে।

পশ্চিমা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, পুতিন শুধু দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখল করে শান্ত হবেন, তা মনে করার কারণ নেই। তাদের ধারণা, পুতিন এই দুটি জায়গায় নিজের সেনাবাহিনী প্রথমে সংহত করবেন। ধীরে ধীরে দখল সম্প্রসারণ করবেন এবং এমনকি কিয়েভও দখল করে নিতে পারেন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপের আশপাশের সমস্ত কাস্পিয়ান উপকূল তিনি দখলে নেবেন।

পশ্চিমা বিশ্বের কেউই ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার হাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেনি, বলছেও না। একইভাবে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় পুতিন একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তিনি গোটা ইউক্রেনকেই দখলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দিতে পারেন। তবে সে ধরনের নির্দেশ এলে তা দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে। পশ্চিমারা প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা কমানো এবং পশ্চিমা ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মস্কোকে বাদ দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রত্যাঘাত হিসেবে পুতিন ইউরোপিয়ান অঞ্চলে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারেন (সেই জ্বালানি চীনে সরবরাহ করার আশা করে ক্রেমলিন) এবং পশ্চিমা শিল্পগুলোতে সাইবার হামলা চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন।

এমন হুমকি এবং প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার বিষয়ে ন্যাটোভুক্ত মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কতটা দৃঢ়, তা এক বড় প্রশ্ন। অতীতে ইউক্রেনের ভাগ্য বিনির্মাণে তাদের আগ্রহ ছিল খুবই ক্ষীণ। ২০০৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি সেই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিল।

জার্মানি ও ইতালি উভয়ই রাশিয়ার কাছ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনে থাকে। ফ্রান্সের সঙ্গে তারাও রাশিয়ার সঙ্গে টক্করে না গিয়ে আলোচনার পক্ষে। অর্থাৎ পুতিনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সেই ইস্যুতেই ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যেই মতবিরোধ আছে। আর এটিকেই পুতিন সবচেয়ে বড় সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। এটি সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, রাশিয়াকে উত্তেজিত করে তোলার বিষয়ে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের মত নেই। যেহেতু যুক্তরাজ্য ছাড়া বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশই পুতিনের প্রতি আপসকামী মনোভাব দেখানোয় বেশি আগ্রহী, সেহেতু এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের সঙ্গে পেরে উঠবে না। এটি যত স্পষ্ট হচ্ছে, পুতিন তত আগ্রাসী হচ্ছেন।

সূত্র: এশিয়া টাইমস

লেখক: ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সাবেক বিদেশসংক্রান্ত সংবাদদাতা

Link copied!