করোনাকালে অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন ১১ হাজার মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২২, ০৩:১২ এএম

করোনাকালে অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন ১১ হাজার মানুষ

করোনা মহামারির পর পাল্টে গেছে আমাদের প্রাত্যহিক-কর্ম, জীবন-ভ্রমন-বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-সমাজ সবকিছুই। মহামারি আমাদের বড় যে ক্ষতিটা করেছে সেটি হল আমাদের মনোজগতের সমূহ ভাবনার ধরনটাই বদলে দিয়েছে। হতাশা আর ক্ষোভ বাসা বেঁধেছে বহু মানুষের মনে। এই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে অনেকে আত্মঘাতী হয়েছেন। চিত্রটা বিশ্বের সব দেশেরই প্রায় একই।

বেসরকারি সংস্থা টেলিসাইকিয়াট্রি রিসাার্চ এন্ড ইননোভেশন নেটওয়ার্ক (ট্রিন) এর মতে, শুধু করোনাকালের অবসাদের কারণে দুই বছরে দেশে প্রায় ১১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু এক বছরেই (২০২১ সালে) ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গত মঙ্গলবার (২২শে ফেব্রুয়ারি) দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ আয়োজিত এক কর্মশালায় বিশেষজ্ঞ বক্তারা এসব তথ্য দেন।

Mental health-00
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের একাংশ। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের বাংলা মোটর প্রধান অফিসে আয়োজিত ওই কর্মশালায় বক্তারা বলেন, এখনও হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন লাখো কোটি মানুষ। কেউ কর্ম হারিয়ে, কেউ হঠাৎ দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্র হয়ে, কেউ ব্যবসা হারিয়ে, কেউবা অনিশ্চিত ভবিষ্যত ভেবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। এসব কারণে শুধু আত্মহত্যা নয় মানুষের ব্যবহারেও এসেছে নানা পরিবর্তন। যা মানুষকে পুরোপুরি একা করে দিচ্ছে।

এই হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলোকে মানসিকভাবে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য করোনার শুরু থেকেই কাজ করে যাচ্ছে টেলিসাইকিয়াট্রি রিসাার্চ এন্ড ইননোভেশন নেটওয়ার্ক (ট্রিন)। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা, প্রজেক্ট ও কর্মশালা করে আসছে তারা। এতে ভাল ফলাফল ও সাড়া পাচ্ছে তারা। তারই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে ওই কর্মশালার আয়োজন করে ট্রিন।

Mental health-02

টেলিসাইকিয়াট্রি রিসাার্চ এন্ড ইননোভেশন নেটওয়ার্কের হয়ে কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন সাইকোলজিস্ট (মনোবিজ্ঞানী) মেহেদী হাসান ও ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট শারমিন আরাসহ সংগঠনের অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকরা। দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সম্পাদক লুৎফর রহমান হিমেলসহ অন্যান্য সহকর্মীরা।

Mental health-editor

কর্মশালার শুরুতে ট্রিন এর প্রশংসা করে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সম্পাদক লুৎফর রহমান হিমেল বলেন, তারা যে কাজটি করছে তা খুবই প্রশংসনীয়। করোনার পর থেকে মানুষজন নানা কারণে হতাশার মধ্য দিয়ে ভিন্নরকম এক জীবন কাটাচ্ছে। জনারণ্যে যেন একাকী তারা। অনেককেই আমরা চোখের সামনে আত্মহত্যা করতে দেখছি। খবরে পড়ছি তাদের কথা। এসব সংবাদ আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। এ কারণে আমাদের হতাশ ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। তাদের কথা বলতে হবে। পৃথিবীতে একা একা সুখি হওয়া যায় না। সে জায়গা থেকে এই কর্মশালাটা খুবই সময়োপযোগী একটি উদ্যোগ।

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সম্পাদকের সভাপতিত্বে কর্মশালায় মূল আলোচনা শুরু হয়। ট্রিনের সাইকোলজিস্ট মেহেদী হাসান ও ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট শারমিন আরা তাদের বিশ্লেষণধর্মী মাঠ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। শুরুতে তারা কে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছে তা উপস্থিত সংবাকর্মীদের কাছে জানতে চান।

Mental health-Sharmin

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের রিপোর্টিং বিভাগের সমন্বয়ক গোলাম রাব্বানী প্রশ্ন রাখেন, ‘কেনো মানুষ আত্মহত্যা করছে? আত্মহত্যার আগে সেটি বুঝবার কোনো উপায় আছে কিনা যে ব্যাক্তিটি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে?

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের অনেক কর্মীই এ সময় একে একে তাদের জীবনের হতাশার গল্পগুলো সবার সাথে শেয়ার করেন।

সব প্রশ্ন শোনার পর বিশেষজ্ঞ শারমিন আরা ও মেহেদী হাসান তাদের বক্তব্য শুরু করেন। তারা দুশ্চিন্তা কমানো, প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়ে সবিস্তার তুলে ধরেন। স্বাস্থ্য বলতে যে শুধু শারিরীক স্বাস্থ্যই নয়, সেটিরও ব্যাখ্যা করেন। শারিরীক স্বাস্থ্যের চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করার দিকে জোর দেন তারা। আত্মহত্যা প্রবণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। উচ্ছ্বল মানুষটি চুপসে গেলে, চুপসে যাওয়া মানুষটি হঠাৎ করেই অহেতুক বেশি হাসিখুশি হয়ে উঠলে তার দিকে ভাল করে খেয়াল করার কথা বলেন তারা। আত্মঘাতী হয়ে উঠার প্রবণতার মধ্যে এগুলোও একটি লক্ষণ।

ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট শারমিন আরা বলেন, বেঁচে থাকলে মানসিক চাপ আসবেই। নানা দিক থেকেই আসবে। এই চাপ কাটিয়ে উঠা বা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় ভাবতে হবে। তবেই জীবন সুন্দর ও সুখি হবে। ধরা যাক একটি পানির বালতিতে অনেকগুলো নল দিয়ে পানি আসতে শুরু করল। একটু পরে বালতি উপচে পড়বেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের ভাবতে হবে বালতি থেকে অপসারণের উপায়। সেরকমই আমাদের মনের ওপর নানা দুশ্চিন্তার সমাবেশ কমাতে হবে। নাহলে ওভারফ্লো হবে।

Mental health Hasan

সাইকোলজিস্ট মেহেদী হাসান বলেন, মানুষ বিভিন্নভাবে মানসিক চাপে থাকেন। এটি স্বাভাবিক। সেই চাপ কমানোর উপায়ও আছে। নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিও আছে। সব সময়ই যে কোনো পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে।

কর্মশালার এক পর্যায়ে ১০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়। সে সময় একটি মনস্তাত্বিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ জন্য কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়। এ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা নিজেরাই বুঝতে পারেন কে কতটুকু হতাশার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।

কেবল নিজের স্বার্থরক্ষাই মানব জীবনের লক্ষ্য নয়। পরস্পর পরস্পরের কল্যাণে ও উপকারের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতাই মানব জাতির সমাজ বন্ধনের ভিত্তি। কবির ভাষায়: সকলের তরে সকলে আমরা। তাই হতাশাগ্রস্ত পরিবার-স্বজন ও প্রতিবেশীদের দিকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বাণ জানানোর মধ্য দিয়ে কর্মশালা শেষ হয়।

 

Link copied!