করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, না রাখার যুক্তি

অ্যারন ই ক্যারল

জুন ২, ২০২১, ০৬:১৭ এএম

করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, না রাখার যুক্তি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে কার্যকরী একটা পদক্ষেপ হলো সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। তবে এ ক্ষেত্রে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ রাখা। প্রশ্ন হলো, কোনটি বেশি উপযোগি? স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা রাখা, নাকি জীবনের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্কুল বন্ধ রাখা।

সত্যিটা হলো, এ বিষয়টির পক্ষে ও বিপক্ষে গোটা বিশ্বেই জোরালো বিতর্ক চলছে।

Covid-school

বিশেষজ্ঞদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, যদি দেশে দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে, তাহলে রোগীর চাপে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এর চেয়ে জনগণকে দূরত্ব মানিয়ে যদি সংক্রমণের রাশ টেনে ধরা যায়, তবে কমসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হবে, এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে।

অন্যদিকে শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কম থাকে। যদি তারা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তারা হয়ত বুঝতেও পারবে না যে তারা সংক্রমিত হয়েছে। ফলে বহু মানুষের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে সহজেই।

প্রাপ্তবয়স্কেদের বোঝানো যায় যে কীভাবে একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তাই তাদের হয়তো বুঝিয়ে সংক্রমণরোধে ভূমিকা পালনের অনুরোধ করে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু শিশুদের এ বিষয়গুলো পুরোপুরি বোঝানো প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাঙ্গণের পরিবেশ করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য একেবারে উপযুক্ত একটি স্থান। অনেক শিক্ষার্থী ছোট একটি শ্রেণিকক্ষে একসঙ্গে থাকে। যেখানে প্রত্যেকের মাঝে ছয় ফুট দূরত্ব মেনে চলা অসম্ভব এক ব্যাপার। তাদের ভিন্ন বিষয়ের ক্লাশ করতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি কক্ষে যেতে হয়। ক্যান্টিনে যেতে হয় টিফিনের সময়, সেখানে সহপাঠীদের সাথে পাশাপাশি বসে খাবার খেতে হয়।

শুধু শিশুরা নয়, স্কুলগুলোতে অসংখ্য প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরাও থাকেন। যেমন শিক্ষক, খাদ্য প্রস্তুতকারী শেফ, নিরাপত্তারক্ষীরাসহ অন্যান্য স্টাফরা। স্কুল খোলা থাকলে তারাও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বেন যেটি তাদের জন্য ভয়াবহ বা জীবন ঝুঁহকিও হতে পারে।

মহামারির প্রথম ঢেউয়েও আমরা দেখেছি, স্কুল বন্ধ রাখায় করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

২০০৬ সালে ন্যাচার সাময়িকীর পক্ষ থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জাকে মডেল ধরে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মহামারীতে আক্রান্তের হার চূড়ান্ত থাকার সময়ে স্কুল বন্ধ করা হলে সংক্রমণের গতি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে।

২০১৬ সালে বিএমসি ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালিত আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০০৯ সালের এইচ১এন১ মহামারির প্রভাবে স্কুলগুলো বন্ধ করার ফলে সংক্রমণের হার ২৫ শতাংশ এবং প্রবল সংক্রমণের সময়েও এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে যেতে পারে।

DSCF6912

এমন কি ১৯১৮-১৯১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যে শহরগুলি ফ্লু মোকাবিলার ব্যবস্থা নিয়েছিল তাদের সঙ্গে যে শহরগুলো কোনও ব্যবস্থা নেয়নি তাদের মধ্যে তুলনা করে ২০০৭ সালে দ্য জার্নাল অব দি আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন— (জেডএএমএ) জানিয়েছিল যে, স্কুল বন্ধের মতো পদক্ষেপগুলো মহামারীতে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর পাশাপাশি সংক্রমণ কমাতেও সাহায্য করে।

চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া এরমধ্যেই তাদের সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে এবং তারা শনাক্তের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে পেরেছে।

স্কুল খুলে দেওয়ার বিষয়ে যুক্তি

শিশুরা যখন কোনো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংস্পর্শে  আসে তখন সেটা স্পষ্টত বিপদ। স্কুল খোলা রাখলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাব্য ভয়াবহতা অনুমান করা  হচ্ছে সেসব গবেষণা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই। আমরা জানি না, এসব উপাত্ত করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে কেমন হবে। 

স্কুল বন্ধ রাখলে ক্ষতি ও শিক্ষার খারাপ পরিস্থিতি অবশ্যই রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক স্কুল অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে অনেকেরই যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই। ইন্টারনেট সংযোগ যেমন অনেকের নেই, আবার অনেকের এ সম্পর্কিত তেমন সরঞ্জামও নেই। সর্বোপরি ই-লার্নিং পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মতো উপযুক্ত পরেবেশের অভাবে আমেরিকায় অর্ধেক সেমিস্টারের সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

শিশুদের যত্নআত্তিত্বেও ব্যাঘাত ঘটছে। খোদ আমেরিকায় এমন ১৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের জন্য স্কুলই নিরাপদ এক আশ্রয় স্থল। শিক্ষার্থীদের একা থাকা কখনই সম্ভব হয় না। বাবা-মা যদি বাসা থেকে তাদের পেশাগত কাজ চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পান, তবেই তাদের দেখাশোনা করা সম্ভব হয়। অন্যথায় তাদের হয় একাকি থাকতে হয় অথবা দাদা-দাদী বা এরকম বয়স্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়। এই বিষয়টি আরো বিপজ্জনক এ কারণে যে, এতে বয়স্কদের সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকি থাকে। এছাড়া ম্ব্যাস্থখাতের কাজ করছেন এমন লোকজনেরও স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে ইদানিং। স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত লোকজন সন্তানদের যত্ন নেওয়ার জন্য তাদের পেশাদারি কাজকে এড়িয়ে যাচ্ছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, আমেরিকায় ৩ কোটি শিশু স্কুলের দেওয়া দুপুরের খাবারের ওপর নির্ভশীল। দেড় কোটি শিশু সকালের নাস্তার জন্য স্কুলের ওপর নির্ভর করে। এসব স্কুল বন্ধ থাকার সঙ্গে শিশুদের ক্ষুধার্ত থাকার বিষয়টিও সম্পর্কযুক্ত। সে কারণেই নিউইয়র্কে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তটি বেশ বিতর্কিত।

বিষয়টি এমন নয় যে স্কুল বন্ধ করতেই হবে। রুটিন পরিবর্তন করে, সামজিক দুরত্ব নিশ্চিত করে, নিয়মিত হাত ধূয়ে, নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্কুল বন্ধের মতো পদক্ষেপ এড়িয়ে যাওয়া যায়। সিঙ্গাপুর তাদের স্কুল বন্ধ না করেও বেশ ইতিবাচক সাফল্য পেয়েছে।

max1200

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, স্কুল বন্ধের ক্ষতির চেয়ে খোলা রাখার উপকারিতা বেশি মিলছে। কারণ ক্ষতিগুলোকে পুষিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন পথ রয়েছে।

স্কুলের সময়সূচি কমিয়ে আনা, স্কুলের প্রথাগত শিক্ষা কাঠামোয় বদল আনার মাধ্যমেও স্কুল বন্দের সিদ্ধান্ত পরিহার করা যায়। অন্যদিকে, স্বাস্থ্যকর্মীদের যারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে বেশি থাকেন, তাদের সন্তানদের জন্যও বিশেষ যত্ন নেওয়া যায়।

আমাদের এখনকার তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে, সংক্রমণের উর্দ্ধগতির কার্বরেখাকে নামিয়ে আনা যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। উপরন্তু স্কুলগুলো খোলার বদলে এখন প্রয়োজনীয় কোভিড টেস্ট চলমান রাখা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাই হবে সবচে বড় সুবিচেনার কাজ।  

মূল লেখা: অ্যারন ই ক্যারল। ইন্ডিয়ানা স্কুল ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিনের শিশু বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক।

ভাষান্তর: তাবাসসুম সুইটি।

Link copied!