কর্নেল তাহের: নিঃশঙ্ক চিত্তের অধিকারী এক বিপ্লবী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ১৪, ২০২১, ১১:২২ পিএম

কর্নেল তাহের: নিঃশঙ্ক চিত্তের অধিকারী এক বিপ্লবী

কর্নেল তাহের- নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বামপন্থী বিপ্লবী এক নেতার মুখ যিনি মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছিলেন ঔপনিবেশিক শোষণমুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত একটি জনযুদ্ধ হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আসামান্য অবদান রাখায় ১১ নং সেক্টরের এই কমান্ডার বীর উত্তম খেতাব লাভ করেছিলেন। প্রহসনের বিচারে ফাঁসি হয় তার। সেই ফাঁসির মঞ্চেও তিনি ছিলেন ভয়ডরহীন। বলেছিলেন, ‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় সম্পদ নেই।’

পুরো নাম আবু তাহের। ১০৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসাবে যোগ দিয়ে ১৯৬২ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কাশ্মীর ও শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় পাকিস্তান সরকার তাকে 'মেরুন প্যারাস্যুট উইং' সম্মামনায় ভূষিত করে। এই সম্মামনা বাঙালি অফিসার হিসেবে একমাত্র তিনিই পেয়েছিলেন।

ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার মতো একটা অসম্ভব ক্ষমতা ছিলে কর্নেল তাহেরের। তিনি যুক্তির স্বচ্ছ আলো দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন। একজন মানুষের পক্ষে ঠিক যতটুকু প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব তিনি নিয়েছিলেন। নিজের ভাই-বোনদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। একসময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে পূর্বপাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) এসে মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করার সময় তিনি নিজের একটি এক পা-ও হারান।

মুক্তিযুদ্ধের পরে তাহের প্রথমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর  লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে দায়িত্ব পালন করেন। তবে মতবিরোধের জন্য পদত্যাগ করেন। বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত এই নেতার নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান কারামুক্ত হন। পরবর্তীতে দায়েরকৃত এক হত্যা মামলায় তাহেরকে সামরিক আদালতে অন্যায় বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ২২ মার্চ সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির রায়কে অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট।

কর্নেল তাহেরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, “কর্নেল তাহের, সময়ের সাহসী পুরুষ। যার কাছে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির মানে হচ্ছে সামগ্রিক মুক্তি। যিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, বরং মুক্তিকামী একটি নিপীড়িত জাতির মুক্তিচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।”

হাসানুল হক ইনু আরও বলেন, “কর্নেল তাহের বুঝতে পেরেছিলেন, পরাধীন দেশের ঔপনিবেশিক কায়দায় গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী কখনোই স্বাধীন দেশের উপযোগী হতে পারে না। তাইতো স্বাধীনতার পর তিনি সেনাবাহিনীকে আমলাতান্ত্রিক, শাসকের হাতিয়ার বাহিনীর ঔপনিবেশিক কাঠামোর পরিবর্তে জনতার বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তযোদ্ধাদের ক্ষেতে নামিয়েছেন। ল্যাট্রিন বানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, “কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসী আর মুরগি খেয়ে গেরিলা যুদ্ধ হয় না। যদি কোনো কৃষকের গোয়ালে রাত কাটাও, সকালে গোবরটা পরিষ্কার কোরো। যে দিন অপারেশন না থাকে তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা লেট্রিন তৈরি করে দিও। তাদের সঙ্গে ধান কাটো, ক্ষেত নিড়াও।’

এরই বাস্তব চিত্র দেখতে পাওয়া যায় স্বাধীনতার পর। ১৯৭২ সালে তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কৃষিকাজ করেছেন। নিজে করেছেন এবং অফিসার সৈনিকদের দিয়ে করিয়েছেন। সেখান থেকে ড্রেজিং কর্পোরেশনে গিয়েও একই কায়দায় কাজ করেছেন সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে।

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরের কথা এলে কর্নেল তাহেরের কথা এসে যায়। জিয়াউর রহমানকে খুবই ভরসা করতেন কর্নেল তাহের। জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্তও করেছিলেন তাহের। আর সেই জিয়াউর রহমান প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করেন।

তবে জিয়াউর রহমান বা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের কাছে কখনও প্রাণ ভিক্ষা চাননি। মৃত্যুর আগে ১৯৭৬ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সায়েমের দপ্তর থেকে দেখা করার কথা বলা হয়। ওই সময় অনেকে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিলে তাহের ক্ষেপে যান। কর্নেল তাহের ওই সময় বলেন, “আমি তো চোর নই যে ক্ষমা ভিক্ষা করব। আমার ফাঁসি হতে পারে না।’

কর্নেল তাহের সব সময় সংগ্রামের ওপরই জোর দিয়েছেন, আপসের কথা বলেননি। তাইতো বন্দী হওয়ার পরও মুক্তির জন্য ক্ষমতাসীন জেনারেল জিয়ার কাছে দেনদরবার করেননি। তাহের নিশ্চিত হয়েছিলেন তার আর জেনারেল জিয়ার পথ এক নয়। ১৯৭৬ সালের ১৫ জুলাই স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, “জিয়াকে আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে তাকে দিয়েছিলাম সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান, কিন্তু সে আস্তাকুঁড়ে ফিরে গেছে। ইতিহাস আমাদের পক্ষে।”

নিশ্চিত ফাঁসি জেনেও কর্নেল তাহের একটুও টলেননি। মামলার রায়ের পর উকিলদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, “এ সেই সরকার, যাকে আমি ক্ষমতায় বসিয়েছি। এদের কাছে আপনারা কিছুই চাইবেন না। ...এই দেশদ্রোহীদের কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না।”

ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও কর্নেল তাহের বিপ্লবের কথা বলেছেন। ফাঁসির দড়িতে ঝোলার আগে তিনি একই মামলায় দণ্ডিত সামরিক অফিসার মেজর জিয়াউদ্দিনের একটি কবিতা পাঠ করেন। “জন্মেছি সারাদেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম/ জন্মেছি তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙবো বলে ভেঙে দিলাম/ জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করবো বলে করেই গেলাম/ জন্ম আর মৃত্যুর বিশাল পাথর রেখে গেলাম/ পাথরের নিচে শোষক আর শাষকের কবর দিলাম/ পৃথিবী, অবশেষে বিদায় নিলাম।”

Link copied!