কার্ল মার্ক্স: সর্বহারা আন্দোলনে নিজেই হয়েছিলেন সর্বহারা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ১৪, ২০২৩, ০৩:৩৪ পিএম

কার্ল মার্ক্স: সর্বহারা আন্দোলনে নিজেই হয়েছিলেন সর্বহারা

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগানে শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়ে সচেতন করতে আমৃত্যু সংগ্রামী মহামানব কার্ল মার্ক্স এর মৃত্যুদিন আজ ১৪ মার্চ। কা্র্ল মার্ক্স একাধারে দার্শনিক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বভাব কবি।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত এই জার্মান চিন্তাবিদের সার্টিফিকেট নাম কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স। ১৯১৮ সালের ৫ মে জার্মানীর প্রাশিয়ার ত্রিভস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করেন এবং ১৮৪১ সালে তিনি ইউনিভারসিটি অফ জেনা থেকে পি.এইড.ডি ডিগ্রী লাভ করেন।

কার্ল মার্ক্স’র  উদ্দেশ্য ছিলো অধ্যাপক হওয়ার। এজন্যই তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।পরবর্তীতে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে ওই ইচ্ছা ত্যাগ করেন।

অধ্যাপক না হতে পারলেও মানবজাতির অন্যতম সেরা শিক্ষকদের একজন কার্ল মার্ক্স। মহামতি কমরেড ভ. ই. লেনিন কার্ল মার্ক্স সম্পর্কে বলেছেন,  “প্রতিভাধর পূর্ণতাসাধক’। কোন্ দিক দিয়ে সেটা? লেনিনের ভাষায়, ‘জার্মান চিরায়ত দর্শন, ইংরেজি চিরায়ত অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি বিপ্লবের মতবাদ—মানবজাতির সবচেয়ে অগ্রসর তিনটি দেশে আবির্ভূত...এই তিনটি প্রধান ভাবাদর্শগত প্রবাহের।”

পেশাগত জীবন শুরু করেন সাংবাদিকতা দিয়ে। কার্ল মার্ক্স রাইনল্যান্ডের যুবকদের দ্বারা পরিচালিত ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদ পত্র’ নামক পত্রিকায় যোগ দেন এবং ১৮৪২ সালে তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। সম্পাদক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকেই ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে কাগজটির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। এই সময় মার্ক্স অর্থশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার পাঠ নেওয়া শুরু করেন।

১৮৪৩ সালে প্যারিসে শুরু করেন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে ইউরোপীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। আর মার্ক্সের এই সংগ্রামে পাশে এসে দাঁড়ান তার অকৃত্রিম বন্ধু ও সহযোগি ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। ১৮৪৫ সালে প্রাশিয়ার সরকারের ষড়যন্ত্রে তিনি প্যারিস থেকে পরিবার সমেত বিতাড়িত হন এবং তিনি চলে যেতে বাধ্য হন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে।

প্রথম জীবনে মার্ক্স’র চিন্তাধারায় হেগেলের প্রভাব লক্ষ করা যায়। পরবর্তীসময়ে তিনি বিপ্লবী গণতন্ত্রের বদলে সর্বহারার সাম্যবাদ এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ওপর গুরুত্ব দেন। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ধ্যান ধারণা ও দর্শন চিন্তায় অদ্ভুত মিল তাঁদেরকে আজীবনকালের সুহৃদে পরিণত করে।

কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ প্রচার করেন। এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে তিনি অর্থনীতি, ইতিহাস, দর্শন – এক কথায় রাষ্ট্রব্যবস্থার যে-সব তত্ত্ব প্রচার করেন তার ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠে কমিউনিস্ট আন্দোলন।

বিপ্লবী কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরিখেএঙ্গেলসের তত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্ত্ব-মার্ক্সবাদ। প্রয়োগিক বিবেচনায় মার্ক্সববাদ হচ্ছে মালিক শ্রেণির তথা বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণ,নির্যাতন, নিপীড়ন তথা মজুরি-দাসত্ব থেকে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির মতবাদ। এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বৈপ্লবিক সাধনক্রিয়ার সামগ্রিক রূপ। ঊনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংরেজি অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্র রূপে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মার্কসবাদ সে সবের বৈধ উত্তরাধিকার।

দ্য কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো’ ছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো- দ্য ক্যাপিটাল, ভ্যালু প্রাইস এন্ড প্রোফিট, দ্য ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি, দ্য পুওভার্টি অব ফিলোসফি  উল্লেখযোগ্য। তবে তার কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো একটি অমর সৃষ্টি যাকে অনেকে ‘সর্বকালের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলিল’ বলে অভিহিত করেছেন।

দাস ক্যাপিটাল, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো এবং আরো অনেক জনপ্রিয় লেখার লেখক হলেও শেষ জীবনটা সুখের হয়নি। চরম অর্থকষ্টে ভূগে ১৮৮৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে জীবনের অনেক কষ্টের মধ্যেও তিনি বিচলিত হননি। সর্বহারার হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি নিজেই একজন সর্বহারা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। দীন দরদি, দীপ্ত উজ্জ্বল সমাজতান্ত্রিক ব্যক্তিটি তাই আজও অমর হয়ে রয়েছেন।

Link copied!