কিশোর কুমার: সঙ্গীতে বিরল এক সুরের যাদুকর

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ১৩, ২০২২, ০৬:০২ এএম

কিশোর কুমার: সঙ্গীতে বিরল এক সুরের যাদুকর

গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক-সব বিশেষণেই বিশেষিত তিনি। ভারত উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে এখনও তিনি ধ্রুবতারা। তিনি আর কেউ নন, কিশোর কুমার। যাকে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সঙ্গীতে প্রথাগত কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না কিশোর কুমারের।  নাচ,গান, অভিনয় সব দিকেই সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। তার মতো বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী ভারতীয় সিনেমা শিল্পে বিরল। কিশোর কুমার এমন একজন শিল্পী যিনি পর পর আটবার ফিল্মফেয়ার আ্যওর্য়াড পান। তার  এই রেকর্ড এখনও অক্ষুন্ন রয়েছে।

১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় জন্মগ্রহণ করা কিশোর কুমার ছিলেন চার ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।  আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কিশোর কুমার বলিউডে ক্যারিয়ার শুরু করেন ‘বম্বে টকিজে’ কোরাস সিঙ্গার হিসেবে। ওই সময় অশোক কুমার ছিলেন বলিউড ইন্ডাস্ট্রির সুপার স্টার।  তার ইচ্ছে ছিল কিশোর কুমারও অভিনেতা হোক। তবে ছোট কিশোরের মন পড়েছিল গানের দিকেই।

১৯৪৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শিকারি’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে রুপালি পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন কিশোর কুমার।  তবে এই ছবিতে প্রধান চরিত্রে ছিলেন বড় ভাই অশোক কুমার। এরপর ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ এর মধ্যে ২২টি ছবিতে কাজ করেন কিশোর কুমার। তবে অভিনেতা হিসেবে সফল হতে পারেননি তিনি। তার অভিনীত  ১৬টি ছবি ফ্লপ করে। পরে অবশ্য ‘লড়কি’ ও ‘বাপ রে বাপ ‘ছবিতে সাফল্য পাওয়ার পর পরিচালক-প্রযোজকরা অভিনেতা হিসেবে তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।  

https://www.youtube.com/watch?v=r0Mm6B6vwxc

কিশোর কুমার পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে একজন প্রতিষ্ঠিত কমেডি নায়ক হিসাবে জনপ্রিয় হন। তার অভিনয়ের কায়দা ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওই সময়ের প্রবল জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাশালী তিন নায়ক ছিলেন রাজ কাপুর, চির সবুজ নায়ক দেব আনন্দ ও দিলীপ কুমার। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিজের এই প্রভাবশালী নায়কদের রাজত্বে কিশোর কুমার কুমারও পৃথক এক জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি ছিলেন এক প্রবল ব্যস্ত, সফল নায়ক এবং গায়ক। এছাড়াও তিনি সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করতে লাগেন।

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিশোর কুমারের অগনিত অনুগামী। তার ভক্তের সংখ্যা অগনিত। তবে কিশোর কুমার নিজে ছিলেন হলিউডের সংগীত শিল্পী ড্যানি কেই -এর ভক্ত। ‘রূপ তেরা মাস্তানা’ গানের জন্য ১৯৭০ সালে প্রথম ফিল্মফেয়ার আ্যওর্য়াড পান কিশোর কুমার। প্রথমবার ভারতীয় গানে ইউডলিং-এর ব্যবহার কিশোর কুমার করেন। তার গানের মধ্যে এই স্টাইলটি বিখ্যাত সংগীত শিল্পী জিমি রডগ্রেস এবং টেক্স মর্টন এর স্টাইল থেকে অনুপ্রাণিত। বরেণ্য সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মনের কথাতেই কিশোর ওই স্টাইলটি রপ্ত করেন।

কিশোর কুমার সব থেকে বেশী কণ্ঠ দিয়েছেন রাজেশ খান্নার জন্য। তার গাওয়া প্রায় ২৪৫ টি গানে কণ্ঠ মিলিয়েছেন রাজেশ। তারপরই রয়েছেন দেব আনন্দ, জিতেন্দ্র ও অমিতাভ বচ্চন। পরে কিশোর কুমারে একটি সিনেমাকে কেন্দ্র করে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়।

তার গাওয়া ‘আকে সিধি লাগি দিল পে’ গানটি আজও অনেকের মুখে মুখে শোনা যায়। সবচেয়ে মজার বিষয়, এই গানটি ছেলে ও মেয়ের গলায় গেয়েছেন তিনি। গানের মেয়ের কণ্ঠের অংশটি লতা মঙ্গেশকরের গাওয়ার কথা থাকলেও কোনো এক অজানা কারণে তা হয়নি।

১৯৭৫ সালের ঘটনা। দেশে জরুরি অবস্থা চলার সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একটি সভায় গাইতে বলা হয়। তবে জরুরি পরিস্থিতির কথা ভেবে কিশোর কুমার ওই গান গাওয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। এর শাস্তি হিসেবে কিশোর কুমারকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারতীয় রেডিও ও দূরদর্শন।

হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীতের উপর কিশোর কুমারের প্রভাব এখনও বিশাল ও ব্যাপক। বর্তমান কালের জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী কুমার শানু, অভিজিৎ, বাবুল সুপ্রিয়, অমিত কুমার সবাই তাদের কেরিয়ারের প্রথম দিকে কিশোরের গানগুলোক অনুকরণ বা নকল করে গাইতেন। তার গানের এখনও খুব ভাল বাজার। তার গানের পুনঃনির্মাণ এবং পুনঃমিশ্রণ বাজারে প্রচুর বিক্রি হয়। তার গাওয়া গানগুলো এখনও সঙ্গীতপ্রেমী মানুষদের কাছে অনুপ্রেরণা। হিন্দি ও বাংলা ভাষার গানে তিনি নতুন এক যুগের সূচনা করেন। সর্বোপরি এখনও পর্যন্ত হিন্দি ও বাংলা ভাষার সঙ্গীতজগতে তার প্রভাব ব্যাপক।

কিশোর কুমারের চার অদ্ভুত কাহিনী রয়েছে। তার জন্ম ৪ই আগস্ট ৪টার সময়। তিনি বাবা-মায়ের ৪র্থ সন্তান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মোট ৪টি বিয়ে করেন। আবার চলচ্চিত্রে অভিনয় জীবনে মাত্র ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রীর নাম রুমা গুহ ঠাকুরতা। আট বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের একমাত্র সন্তান অমিত কুমার। তিনি বাবার মত সাফল্য না পেলেও বেশ কিছু কালজয়ী হিন্দি ও বাংলা সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন। কিশোর কুমারের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম অভিনেত্রী মধুবালা। মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য মুসলিম হন, নাম নেন করিম আবদুল।

মধবালার মৃত্যুর পর তৃতীয়বার বিয়ে করেন অভিনেত্রী যোগিতা বালিকে। তবে এ বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। পরবর্তীতে যোগিতা বালি বিয়ে করেন বলিউড সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তীকে। যোগিতা বালিকে অসম্ভব ভাল বাসতেন কিশোর কুমার। শোনা যায়, মিঠুন চক্রবর্তীকে বিয়ে করায় গান বন্ধ করে দেন এই কিংবদন্তী শিল্পী।

পরে চতুর্থবার বিয়ে করেন সঙ্গীত শিল্পী লীনা চন্দাভারকরকে। এ দম্পতির সন্তান সুমিত কুমারও একজন সঙ্গীত শিল্পী।

 

১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই মহান শিল্পী। মৃত্যুর আগের দিনও তিনি গান রেকর্ড করেছেন। শুনে যেতে পারেনি। তবে তার গান এখনও শুনছেন শ্রোতারা। শ্রোতাদের মাঝেই কিশোর কুমার বেঁচে থাকবেন আজীবন।  

Link copied!