জাতীয় বীরদের সঠিক মর্যাদা ও সম্মান দিতে হবে

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

ডিসেম্বর ২, ২০২১, ০১:১৯ এএম

জাতীয় বীরদের সঠিক মর্যাদা ও সম্মান দিতে হবে

‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালি জাতির গর্বের ইতিহাস। বাঙালি জাতির অহংকারের বীরত্বগাথা। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমরা পেয়েছি আমাদের ঠিকানা, আমাদের স্বদেশভূমি। মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন বাঙালি জাতির সূর্যসন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো জাতীয় অহংকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের লাল-সবুজের পতাকা আর বিশ্বের বুকে এক গর্বিত মানচিত্র।। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি শুনলেই শ্রদ্ধায় নত হয়ে ওঠে হৃদয়। মুক্তিযুদ্ধচলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। মুক্তিযোদ্ধাদের এতো কৃতিত্বের পর বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও স্বীকৃতিস্বরূপ নেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় কোনো দিবস। ২০০৪ সাল থেকে ১ ডিসেম্বরকে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সরকারের সংশ্লিষ্টরা দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করলেও দেড় দশক ধরে উপেক্ষিত রয়েছে এই দাবি। 

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি লগ্নেও এই দাবির বাস্তবায়ন করা হয়নি। প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা পালনের প্রস্তাব করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি। সংসদীয় কমিটির এই প্রস্তাবে একমতও প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়। তবুও প্রতি বছরের মতো ১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াই পালিত হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা দিবস। ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সমাবেশ করে ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব দিবসটির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, "কয়দিন পর মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো জীবিত থাকবেন না। কিন্তু দিবস থাকলে সেটিকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে তাদের স্মরণ করার একটা সংস্কৃতি চালু হবে। সেটা ইতিহাসের জন্য জরুরি। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। সেটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।"

বিংশ শতাব্দিতে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলার স্বাধীনতা আর লাল-সবুজের পতাকা। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির অহংকার ও গর্বের বিষয়। দীর্ঘ নয় মাস পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এদেশের বীর বাঙালি যুদ্ধ করে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো জাতীয় অহংকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আর সেই মুক্তিযোদ্ধারা আজ নানান ভাবে অবহেলিত এবং অপমানিত। মুক্তিযোদ্ধদের একটি সঠিক তালিকা অদ্যাবধি তৈরী সম্ভব হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানান ধরণের অনিয়মের অভিযোগ অতীতেও শোনা গেছে, বর্তমানেও যাচ্ছে। চলতি বছর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সুষ্ঠু এবং সঠিক তালিকা জাতির সামনে প্রকাশ বা চূড়ান্ত হয়নি। বরং অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া সনদ নিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ বাংলার আনাচে-কানাচে পড়ে আছেন অসংখ্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। যাদের মুখে দিনে একবার অন্ন জোটে না। তারামন ও কাঁকন বিবির মতো অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা জীবন পার করছেন এ বিলাসী জীবনযাপনকারী ব্যক্তিদের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে,যাদের খবর কেউ রাখে না। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে বিতর্ক চলছেই। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়েছে, এমন অভিযোগ সরকার নিজেও স্বীকার করে। কিন্তু বাংলাদেশে ভুয়া বা অ-মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ঠিক কতো, সে বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। যেমনটি নেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সুষ্ঠু এবং সঠিক গ্রহণযোগ্য তালিকা। 

গবেষকেরা মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অনিয়ম এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণের যে অভিযোগ রয়েছে, তার পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানান কারণ রয়েছে। গবেষক আফসান চৌধুরী মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিতর্ক হওয়ার পেছনে রাজনীতির সাথে কিছু কাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। তিনি বলেন, "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র ছিল কিছুটা ইন-ফর্মাল। ইন-ফর্মাল যুদ্ধের সমস্যা হচ্ছে সেখানে রেকর্ড বড় বিষয় থাকে না। এখন মুক্তিযুদ্ধে মোট কত লোক অংশ নিয়েছে সেটা কেউ হিসেব করে বলতে পারবে না। এমনকি ক্যাম্পে গিয়ে কত লোক ছিল, তার কিছুটা বলতে পারবে, কিন্তু সবটা পারবে না। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে কেউ ভাবত না। তখন সনদ ছিল, কিন্তু কোন ভাতা ছিল না। কিন্তু জিয়াউর রহমান আসার পরে পুরো বিষয়টার পুনর্বিন্যাস করা হয়। জিয়াউর রহমান সেসময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তার নিজের লোকেদের নিয়োগ দেয়া হয়। এই সংক্রান্ত রাজনীতি-করণটা মূলত তখন থেকেইা শুরু হয়"। ২০২১ চলতি বছরের ৩০ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ৬১জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বাদ পড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানেরা। 

মোরেলগঞ্জ প্রেসক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান হাওলাদার। এর আগে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি গোপালগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম খলিল, মতিয়ার রহমান খান, মোশারফ হোসেনসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন। এসময় যাচাই-বাছাই বন্ধসহ ৭ দফা দাবি জানিয়ে বক্তরা বলেন, ‘যাচাই-বাছাইয়ের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের হায়রানী করা হচ্ছে। দ্রুত এসব বন্ধ করতে হবে।’এরপর প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসক বরাবর ৭ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এরও আগে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সৃষ্ট অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিকারের দাবিতে’এক সংবাদ সম্মেলন করা হয়। ‘খেতাবপ্রাপ্ত, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড’নামের একটি সংগঠন এই আয়োজন করে। আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে মহা প্রহসন চলছে বলে অভিযোগ করেন এবং এই প্রহসন বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। 

জানা যায়, পর্যাপ্ত প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যেসকল মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত তাদের পরিবারও এর থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি যারা ২০১৪ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পাচ্ছিলেন, ক্ষেত্রবিশেষ আকস্মিকভাবে তাদের ভাতাও বন্ধ করে দেয়া হয়ছে। অনাকাঙ্খিত এমন ঘটনার সুষ্ঠু জবাব নেই। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভাতা ভোগী মুক্তিযোদ্ধার নাম গেজেটভুক্ত করা হয়নি। কেন হয়নি, সেটার কোন উত্তর না জানিয়ে অনেকের ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ২ এপ্রিল সাভারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘আমিই বঙ্গবন্ধু’ নামে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন ‘আমাদের একটাই শুধু দেখার বিষয়, যে কার সহযোদ্ধা? তার সাথে যদি কমপক্ষে তিনজন সহযোদ্ধা বলে যে, আমার সাথে ট্রেনিং গ্রহণ করেছে বা আমার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, এটাই যথেষ্ট। অন্য কোনোরকম কোনো কাগজপত্রের দরকার নাই।’যদিও মন্ত্রীর কথা বাস্তবতার পরিপন্থী। রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন সম্প্রতি বিবিসি-কে দেয়া এক সাক্ষৎকারে বলেন, "বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, কিন্তু এখন সেটা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধ-কেন্দ্রিক রাজনীতি। এর পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করায় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে অনিয়ম হয়েছে।" 

নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণের জন্য যখন হরেক রকম বিব্রতকর পরিস্থিতি সম্মুখীন হতে হয়, তখন বিষয়টা পুরো রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থা তন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির নামে অসম্মান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের অপমান। জাতীয় বীরদের সঠিক মর্যাদা ও সম্মান দিতে না পারলে জাতির ইতিহাস ও অগ্রগতি থমকে যাবে। আগামী প্রজন্ম যদি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে না পারে, তাহলে কী তারা পারবে দেশকে ভালোবাসতে? নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের জানাতে হবে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অবদান তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই দেশের মর্যাদা বাড়বে, দেশ এগিয়ে যাবে। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচণা করবেন।।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সাংবাদিক। ইমেল: jsb.shuvo@gmail.com

Link copied!