নতুন আলোয় সাঈদা খানম

শাহরিয়ার কবির হিমেল

ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১, ১২:২২ এএম

নতুন আলোয় সাঈদা খানম

ছবি মেলার বিশেষ সংস্করণ ‘‘ছবি মেলা শূন্য”তে দুটি রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী আছে, যার একটি সদ্যপ্রয়াত আলোকচিত্রী সাঈদা খানমের “দ্যা রিবেল উইথ ‍এ স্মাইল।” ‘রেট্রোস্পেকটিভ’ শব্দটা দিয়ে বোঝায় একজন শিল্পীর সারাজীবনের কাজ। কিন্তু সাঈদা খানমের মত একজন শিল্পীর সারাজীবনের কাজকে কি একটি প্রদর্শনীতে তুলে ধরা সম্ভব? কাজটি দুরূহ, সন্দেহ নেই। তবে দৃকপাঠ ভবনের ৩য় তলায় আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে সাঈদা খানমকে নতুন করে দেখবার একটি প্রচেষ্টা আছে।

সাঈদা খানম বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী। কিন্তু তাকে শুধু এই পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার কোনো কারণ নেই। আলোকচিত্রী হিসেবে সাঈদা খানম বাংলাদেশকে অনেক আন্তর্জাতিক সম্মান এনে দিয়েছেন, একইসাথে এদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাই এখন সময় তাকে ও তার কাজকে নতুন করে বুঝবার।

একজন আলোকচিত্রশিল্পীর কাজকে বুঝতে হলে আমরা কী কী খুঁজবো? পেশাগত সাফল্য ও পুরষ্কার নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শিল্পীর কাজের সার্থকতা কি শুধু এখানেই? ছবি কি শুধু বিষয়বস্তু, আলো, ফর্ম? একজন শিল্পীকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে তার জীবন ও যাপন। আর এর আলোকে তার প্রকাশিত কাজের সাথে অপ্রকাশিত কাজগুলোকেও আমাদের দেখতে হবে। এই প্রদর্শনীতে কিউরেটররা সেই চেষ্টাটি করেছেন।

এবারের ছবি মেলার মূল কিউরেটর এএসএম রেজউর রহমান, তানজিম ওয়াহাব, ও সরকার প্রতীক। সাঈদা খানমের প্রদর্শনী ডিজাইনের মূল কাজটি তানজিম ওয়াহাব করলেও বাকি দুজনের সম্মিলিত অবদান রয়েছে এখানে। এই প্রদর্শনীর পেছনে একটি গবেষক দল কাজ করেছেন, যাদের মধ্যে জান্নাতুল মাওয়া এবং দীন মোহাম্মদ শিবলী উল্লেখযোগ্য। এই মানুষগুলো দীর্ঘদিন কাজ করে সাঈদা খানমের অনেক ছবি সংগ্রহ করেছেন। এই প্রদর্শনীতে এমন বেশ কিছু না-দেখা ছবি দর্শক দেখতে পাবেন।

প্রদর্শনীর চারটি অংশ। গ্যালারিতে ঢুকতেই হাতের বাঁ দিকে হালকা বাদামী রঙের দেওয়ালে কতকগুলো ছবি চোখে পড়বে। এই অংশটি পোরট্রেট ফটোগ্রাফি নিয়ে করা। সাঈদা খানম একজন শক্তিশালী পোরট্রেট ফটোগ্রাফার ছিলেন। এখানে বিশেষভাবে তার তোলা নারীদের পোরট্রেটগুলো রাখা হয়েছে। ছবির লাইট, কম্পোজিশনের মুন্সিয়ানা ছাড়াও, একটু সময় নিয়ে গভীরভাবে দেখলে ছবিগুলোর আরও বিশেষত্ব চোখে পড়বে। এই নারীরা সাঈদা খানমের কাছের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু। তিনি বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে, ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন। যার পোরট্রেট করা হয়, তাকে বলে “সিটার”। এই ‘সিটার’দের সাথে সাঈদা খানমের সম্পর্ক যে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল, তা এই ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়। এই ঘনিষ্টতা ছবিতে একধরণের রহস্য তৈরি করে, ছবির মানুষটি সম্পর্কে আমাদের কৌতুহলী করে তোলে। ফটোগ্রাফার ও সিটার-এর মধ্যে ক্যামেরা এখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ছবিগুলো হয়ে উঠেছে সংবেদনশীল ও ব্যক্তিগত, ইংরেজিতে যাকে বলে “ইনটিমেট পোরট্রেট”। আর এখানেই পোরট্রেট ফটোগ্রাফারের সার্থকতা।

এর ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে আরেকটি অংশ। এখানে অনেকগুলো ছবি। সাঈদা খানম ও তার শিল্পী বন্ধুদের অনেকগুলো মুহূর্ত। সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। নিজেও আজীবন ছিলেন শিল্পী, সাহিত্যিক ও শিল্প রসিক। ফলে দুই বাংলার সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক মানুষের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। এমনকি সত্যজিৎ রায়ের মত মানুষেরও তিনি পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। কাজও করেছেন সত্যজিতের তিনটি ছবির সেটে। আবার “মানিকদা”র অন্দরমহলেও ছিল তার অবাধ বিচরণ। সাদাকালো ছবিতে ভরা দেওয়ালটি এমন অনেক উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল মুহূর্তে রঙ্গিন।

গ্যালারির এক কোণার তৃতীয় অংশটি ফটোসাংবাদিক সাঈদা খানমের কথা বলে। এক্ষেত্রে তার কৃতিত্বের কথা আমরা কমবেশি জানি। ‘বেগম’ পত্রিকায় কাজ করেছেন অনেকগুলো বছর। মাদার তেরেসা, বঙ্গবন্ধু, রাণী এলিজাবেথ, চন্দ্রজয়ী মহাকাশচারীসহ অসংখ্য খ্যাতনামা মানুষের ছবি তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তার ক্যামেরা থেমে থাকেনি। প্রায় সকল জাতীয় দৈনিকে তার ছবি ছাপা হয়েছে। এদেশের ফটোসাংবাদিকতার ইতিহাস লিখলে দেখা যাবে, তার সময়ের পুরুষ ফটোসাংবাদিকদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না তিনি।

প্রদর্শনীর চতুর্থ অংশটি একেবারেই অন্যরকম। এখানে যেমন সাঈদা খানমের স্বহস্তে লেখা চিঠি আছে, তেমনি আছে তার সাদাকালো মিডিয়াম ফরম্যাট নেগেটিভ। এই অন্তরঙ্গ জিনিসগুলোর মধ্যে যেন ব্যক্তি মানুষটির একটি ছোঁয়া পাওয়া যায়। এছাড়া একটি টেলিভিশন পর্দায় দেখা যায় তার শেষ সাক্ষাৎকার।

প্রদর্শনীর শিরোনামটিকে আমার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। মিষ্টভাষী মানুষটির সাথে কথা বললেই তার স্নেহপ্রবণ অন্তরটিকে অনুভব করা যেত। অথচ এই নরম-সরম মানুষটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের ভালবাসার কাজটি করে গেছেন। সারাজীবনের কাজ দিয়ে লিখে গেছেন একটি বিদ্রোহী প্রেমের কবিতা। আজ ২০২১ সালেও কি নারীদের এই লড়াই শেষ হয়েছে? আজও কি আমরা নারীর চোখে পৃথিবী দেখতে শিখেছি? সাঈদা খানমের কাজ ও তার জীবনের গল্প আজ তাই আরও প্রাসঙ্গিক। তার ছবিকে তাই আমাদের আরও গভীরভাবে জানা প্রয়োজন। সেই জানবার প্রয়াসে এই প্রদর্শনী নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

Link copied!