নতুন চিন্তা উন্মেষের আবাহনে ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক

জানুয়ারি ৬, ২০২৩, ০৪:০৬ এএম

নতুন চিন্তা উন্মেষের আবাহনে ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর শুরু

ঢাকায় লিট ফেস্ট সাহিত্য উৎসবের দশম আসর শুরু হল বৃহস্পতিবার। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এই আসরে এসে দর্শনার্থীদের প্রথমবারের মত এবার কাটতে হচ্ছে টিকেট। করোনা ভাইরাসের কারণে তিন বছর বিরতির পর এবার এই আসর বসলো। 

এদিন সকাল ১০টা বাজলেও শীতের সকাল আড়মোড়া ভাঙতে ঢের দেরি হচ্ছিল তখনও। কুয়াশার ফাঁক গলে সূর্যের আলোক চ্ছটা তখনও সুধা ঢালতে বাকি; এরমধ্যেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢাকা লিট ফেস্টে জড়ো হয়ে যান অনেক সাহিত্যানুরাগী। তাঁদের পদভারে মূহুর্তেই গমগম করে উঠে আয়োজন স্থল।

পরে সকাল ১১টার দিকে ঢাকায় দশম এই সাহিত্য সম্মিলনীর যখন উদ্বোধন হয়, বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন ছিল একেবারে পরিপূর্ণ। দেশি-বিদেশি লেখক, কবি-সাহিত্যিক আর চিন্তাবিদদের এই মিলনমেলার আড্ডা-গল্পে নতুন চিন্তা উন্মেষের আবাহনে শুরু হয় আয়োজন।

এবারের আয়োজনের আকর্ষণ নোবেল পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ। তাঁকে সাথে করে নিয়ে ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষসহ অতিথিরা উঠেন মঞ্চে। এরপরই তাঁদের সবাইকে নিয়ে চার দিনের ঢাকা লিট ফেস্ট আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। 

আয়োজকরা বলছেন, এবারের আসরে ১৭৫টির বেশি অধিবেশনে অংশ নেবেন পাঁচ মহাদেশের পাঁচ শতাধিক বক্তা, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী ও চিন্তাবিদ। মূলত ইংরেজি ভাষার সাহিত্য নিয়ে দশম এই উৎসবে যোগ দিতে দর্শনার্থীদের প্রথমবারের মত কাটতে হচ্ছে টিকেট। 

উৎসব ঘিরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্টলে থরে থরে সাজানো হয়েছে বই; বর্ণিল আয়োজনের মধ্যে কয়েকটি ভেন্যুতে চলবে আলোচনা অনুষ্ঠান। ঢাকা লিট ফেস্ট উপলক্ষে প্রথমবার ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছেন ২০২১ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী তানজানিয়ান-বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক গুরনাহ। এ উৎসবে সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন নতুন সব বিষয় উন্মোচিত হবে বলে তিনি আশা করছেন। 

ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতায় এ বাংলায় তার পূর্বপুরুষদের শেকড়ের কথা তুলে ধরেন। সেদিকে ইঙ্গিত করে আব্দুলরাজাক গুরনাহ বলেন, অমিতাভ ঘোষের মত আমি বলতে পারব না, এখানে আমার শুরুটা কীভাবে এবং কীভাবে আমি এর সাথে সম্পর্কিত। কারণ, আমি এই প্রথম ঢাকায় এবং বাংলাদেশে এসেছি, এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের এই অংশেও প্রথম। 

সুতরাং, আমি আশা করছি, এমন কিছু বিষয় উন্মোচন হবে, যা আমি আগে কখনো দেখিনি। 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনায় পরিবেশিত মনিপুরী নৃত্যে অভিভূত হওয়ার কথা জানিয়ে গুনরাহ বলেন, সেই নৃত্য পরিবেশনায় আমি নতুন উন্মোচনের কিছু স্বাদ পেয়ে গেছি। খুবই সুন্দর নাচ, মনোরম পোশাক, গান আর ঢাকীদের অসাধারণ উদ্যমী পরিবেশনা। 

নোবেলজয়ী এই সাহিত্যিক মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলেন, আমি এখানে আসতে পেরে আনন্দিত। এটা অসাধারণ একটা শুরু। পরবর্তী অন্য সব আয়োজনের অপেক্ষায় আছি।

নিজের পারিবারিক যোগসূত্রের পাশাপাশি দেশে-বিদেশে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নিজের আত্মিক সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষ। তার মায়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বর্তমান গোপালগঞ্জের, বাবার পূর্বপুরুষরা মুন্সীগঞ্জের।

সেই প্রসঙ্গ ধরে অমিতাভ বলেন, আমি বাংলাদেশের সব গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। আমরা বাংলাদেশের কথা সবসময় বলতাম। আমার দাদী ছিলেন মাদারীপুর জেলার এবং সারাজীবন তিনি মাদারীপুরের ভাষায় কথা বলতেন। এই ভাষা শুনে বড় হওয়া আমার জন্য ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

অমিতাভ বলেন, ভারতে বড় হওয়ার কারণে বাংলাদেশ নিয়ে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ‘অনুপস্থিত’। আমাদের মত যারা দেশভাগের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, কেবল তারাই জানি, সেই অনুপস্থিতিটা আসলে কী।

রোমাঞ্চকর মনিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা জানিয়ে অমিতাভ আরও বলেন, উৎসবের উদ্বোধনে উপমহাদেশের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের উদযাপন দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। এটা ছিল সত্যিকার অর্থে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। আশা করি, এ ধরনের আরও অনেক কিছু হবে। 

এই উৎসব বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে নতুন আলো ও দ্যুতি ছড়াবে বলে মনে করছেন প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করে তিনি বলেন, এর সাথে যাঁরা সম্পৃক্ত হয়েছে এ আয়োজনকে ভালো একটি রূপ দেওয়ার জন্য, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি দশম ঢাকা লিট ফেস্টের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।

ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক সাদাফ সায উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, অনিশ্চয়তার ওই সময়ে আমরা যে কোনো সময়ে চেয়ে বেশি পরিমাণে আমাদের জীবনে সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মূল্য বুঝতে পেরেছি। এটা আমাদেরকে এমন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে যা আমাদের কাছে অধরা হলেও মর্মের গভীরে নিহিত।

সাদাফ বলেন, আজ আমরা এখানে একত্রিত হতে পারা এবং নিজেদের প্রকাশ করতে পারাকে উদযাপন করছি। সমন্বয়ের অনুভবের মধ্য দিয়ে পুনর্ব্যক্ত হতে পারে, আমাদের মধ্যে সাদৃশ্য কী আছে এবং কীভাবে বৈসাদৃশ্য নিয়েও আমরা এগিয়ে যেতে পারি।

বিগত সময়ে সংলাপ, বিতর্ক ও চিন্তাভাবনা প্রকাশের জায়গা হিসেবে ঢাকা লিট ফেস্টকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টার কথাও তুলে ধরেন সাদাফ। তিনি বলেন, বিশ্বের মননশীল মানুষদের আমরা ঢাকায় নিয়ে এসেছি আর বাংলাদেশের মননশীল কিছু মানুষকে নিয়ে এসেছি বিশ্বের কাছে।

উৎসবের আরেক পরিচালক কে আনিস আহমেদ বলেন, লেখকরা নিভৃতে লেখেন; আর বিজ্ঞানীরাও আবিষ্কার করেন নিভৃতে থেকে। তবে, সংস্কৃতি বিকশিত হয় মিলনমেলায়। এই ধরনের মিলনমেলা ক্রিয়াশীল মানুষদের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এখানে আলোচনা, বিতর্ক আর সৃজনশীলতার বিচ্ছুরণ হবে। তবে সেটা কীভাবে ঘটবে, তা এখনই নির্ধারণ করা কিংবা ভবিষ্যৎবাণী করা কঠিন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই শর্মিলা ব্যানার্জির নির্দেশনায় পরিবেশন করা হয় মনিপুরী নৃত্য।

Link copied!