প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুলের ১২২ তম জন্মজয়ন্তি আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

মে ২৫, ২০২১, ০৭:০৩ এএম

প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুলের ১২২ তম জন্মজয়ন্তি আজ

প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২ তম জন্মজয়ন্তি আজ। বাংলাদেশের জাতীয় কবির- এক হাতে ছিলো বাঁকা বাশেঁর বাঁশি, আরেক হাতে রণতুর্য। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে তার কবিতা ও গান  সমানভাবে সমাদৃত।

তার কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে ‘বিদ্রোহী কবি ’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। ভীষণ প্রতিকুলতার মধ্যে বেড়ে উঠেও সৃষ্টিশীল এই মানুষটি জয় করেছিলেন বাঙালির হৃদয়। তার সাম্যবাদী চেতনা আজও উজ্জীবিত করে তরুণ সমাজকে।

জন্ম

১৮৯৯ সালের ২৫শে মে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। বাংলা ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ,আর মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। বাবা মায়ের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া"।

কবি হয়ে ওঠা

আনুষ্ঠানিক পড়াশুনা এগোয়নি কবি নজরুলের। কৈশোরে তিনি যোগ দেন লেটো গানের দলে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। সেখান থেকে ফিরে মুসলিম ভারত পত্রিকায় লেখা শুরু করেন ,তাতেই প্রকাশিত হয় কবির যুগান্তকারী কবিতা বিদ্রোহী।

তৎকালীন প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করতেন নজরুল।

১৯২২ সালে কাজী নজরুল নিজেই প্রকাশ করেন ধূমকেতু পত্রিকা। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন শোষণের বিরুদ্ধে লেখনীতে বলিষ্ঠ হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই ধুমকেতু। এতেই কবি প্রকাশ করেন তার ধুমকেতু কবিতা।

এই কবিতার জন্যই ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হন কবি। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার নজরুলের ধুমকেতু পত্রিকা বন্ধ করে দেন। ১ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় কবিকে। তবে সেই কারাগারে বসেই নজরুল লেখেন, সৃষ্টি সুখের উল্লাস,শিকল পড়ার গান। যেই গানগুলো আজও নবীনদের  উদ্দীপ্ত করে। আলীপুরের সেই সেন্ট্রাল জেলে অবরুদ্ধ কবি ফাসির মঞ্চ দেখেই লিখেন দুর্গম গিরি কান্তার কবিতাটি।

কারাগারে দুর্বব্যবহারের কারণে কবি যখন অনশন করেন তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অনশন ভঙ্গের অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠান। তাকে উৎসর্গ করেন গীতিনাট্য বসন্ত। ব্রিটিশ সরকারের নানা শোষণ জুলুমের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে দারিদ্রের শিকার হোন কবি। ১৯৫৬ সালে কয়েকজন সাহিত্যিক বন্ধুদের উপস্থীতিতে ঘরোয়াভাবে উতযাপিত হয় তাঁর জন্মদিন।

সংসারজীবন

কাজী নজরুলের স্ত্রীর নাম প্রমীলা দেবী। তাদের মোট চার সন্তান ছিলেন- কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুল

অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুল ধর্মের ভেদাভেদ মানতেন না, তাইতো দূর্গার অশুর নিধন শক্তির আধারে লেখেন আনন্দময়ীর আগমনে, লেখেন প্রলোউল্লাস। একই সাথে নজরুল তার গানে আরবি ও ফারসি মিলে নতুন মাত্রা এনেছিলেন এবং তিনিই প্রথম বাংলা গজল গানের প্রবর্তক।

মানবিকতাই ছিলো নজরুলের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্ম, তিনি কখনই ধনী দরিদ্রের ভেদাভেদ মানেননি। যে কারণে এই সময়েও নজরুলকে প্রাসঙ্গিক মনে করেন নজরুল ভক্তরা।

তাঁর সৃষ্টকর্ম

বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজেই "বিদ্রোহী কবি", তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।

ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল।  এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী , অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, মৃত্যুক্ষুধা, হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।

বাংলাদেশে আগমন

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়।

মৃত্যু

মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে  আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়।  ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই":- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়। তবে প্রমিলা দেবীর শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর স্বামীকে যেন তাঁর কবরের পাশে (চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে) সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু প্রমিলার শেষ ইচ্ছাটি আর পূরণ হয়ে উঠে নি।

সম্মাননা

কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তার রচিত "চল্ চল্ চল্, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল" বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে গৃহীত। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়) ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারিভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট- ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।

বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

এছাড়াও কাজী নজরুল ইসলামকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক জগত্তারিণী স্বর্ণপদকও  পদ্মভূষণে ভূষিত করেছে ভারত সরকার।

 

Link copied!