ফিদেল কাস্ত্রো: যে বিপ্লবীর ওপর হামলা হয়েছিল ছয়শরও বেশিবার!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ১৩, ২০২২, ০৮:১৬ পিএম

ফিদেল কাস্ত্রো: যে বিপ্লবীর ওপর হামলা হয়েছিল ছয়শরও বেশিবার!

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার উদ্দেশে তাঁর ওপর কম ক’রে হলেও ছয়শরও বেশিবার হামলা হয়েছে। বিশ্বের আর কোনো নেতার ওপর এমন তরো হামলার নজীর রয়েছে কিনা জানা নেই। এই নেতার ওপর এসব হামলা চালিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) সুপ্রশিক্ষিত সদস্যরা। বরাবরই তিনি মার্কিন ওই গোয়েন্দা সংস্থার হিটলিস্টে ছিলেন।

১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে সিআইএ সর্বাধুনিক রাইফেল থেকে শুরু করে বিষের বড়ি দিয়ে, বিষাক্ত কলম ছুড়ে, ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া পাউডার দিয়ে তাঁকে অসংখ্যবার হত্যার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু কোনো কিছুতেই সফল হয়নি সাম্রাজ্যবাদীদের সেসব অপচেষ্টা।

ফিদেলকে হত্যার জন্য শত্রুশিবির সিআইএর সাথে নিজের এক বোনও হাত মিলিয়েছিলেন গোপনে। কিন্তু নিজের দৃঢ় মনোবল ও সতর্ক দেশ পরিচালনার কারণে এসব অপচেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে বারবার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাই তিনি ছিলেন পূঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক সোচ্চার উচ্চারন। অনেকের কাছে তিনি হয়ে আছেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক প্রতীক। গত এবং বতর্মান শতাব্দীর পরিবর্তনের ধ্বজাধারী সর্বশেষ বিপ্লবী।

Fidel
জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছেন ফিদেল: বিশ্বকে শোষণ মুক্ত করবার অঙ্গীকার আবারও ব্যক্ত করছেন বিপ্লবী

কয়েক বছর আগে কাস্ত্রোর মার্কিন আশ্রিত বোন হুয়ানিতা তাঁর লেখা একটি বইয়ে স্বীকার করেছেন, তিনি ভাই ফিদেলকে উৎখাতে সিআইএর সাথে কাজ করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি গোপনে দেশ ছাড়েন এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে বহুবিধ পরিবর্তন আনার ঘোষনা দেন। তিনি চিরশত্রু কিউবার সঙ্গে অতীত তিক্ততার সম্পর্ক ভুলে নতুন করে সম্পর্ক গড়ার কথাও বলন। এটা সম্ভব হয়েছিল শুধু একজন অনড় বিপ্লবী ফিদেলের জন্যই।

জীবনে বহুবার ফিদেল গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। সংগ্রামের প্রতীক এই বিপ্লবী জীবনের শেষ প্রান্তে আবারও আলোচনায় আসেন প্রেসিডেন্ট ওবামার নেওয়া নীতির ব্যাপারে খোলামেলা কিছু মন্তব্য করে। পরিবর্তন প্রত্যাশী ওবামার দর্শন তাঁকে নাড়া দিয়েছে। ওবামার শপথ অনুষ্ঠানটিও তাই তিনি টেলিভিশনে সরাসরি দেখতে ভোলেননি। শপথের দিন ফিদেল তাঁর ভাষনের প্রশংসা করে ইন্টারনেটে লিখিত বিবৃতিও দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই কিউবা-মার্কিন গত ৫০ বছরের বরফ গলতে শুরু করে।

১৯৫০ এর দশক। ফিদেল তখন টগবগে যুবক। নিজে আইনজীবী ছিলেন বলেই কিনা সমাজের বৈষম্যটা তাঁর চোখে পড়েছিল বেশি করে। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন মার্কিন সমর্থিত একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তার সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসেন তিনি। অবশ্য ১৯৫৩ সালেই ফিদেলের বিপ্লবের প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বাতিস্তার অন্যতম সামরিক ঘাঁটি মোনাকাদা ব্যারাকে ওই বছর ২৬ জুলাই ওই ব্যর্থ হামলাটির পরিকল্পক ছিলেন তিনি। তবে অভিযানে ব্যর্থতার মধ্যেই যেন লুকিয়ে ছিল সাফল্যের বীজ। কিউবাবাসী তখন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, গুটিকয়েক গেরিলা সেনার ছদ্মবেশে কীভাবে সামান্য ক্ষুদ্রকায় রাইফেল নিয়ে বৃহৎ একটি সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমন করল। তাঁরা বুঝতে পারল, খুব শিগগিরই দেশে পরিবর্তন আসছে। ওই সময় গ্রেপ্তার এবং পরে নির্বাসনে যেতে হয় ফিদেলকে।

Fidel che
ফিদেল এবং চে: বিপ্লব সতীর্থ দুই জনেরই স্বপ্ন ছিল বিশ্বকে মুক্ত করবার।

এক পর্যায়ে ১৯৫৬ সালে কাস্ত্রো মেক্সিকোর নির্বাসন থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরেক কিংবদন্তী গেরিলা এরনেস্তো চে গুয়েভারা। ১৯৫৯ সালে মাত্র ৯ হাজার গেরিলা নিয়ে তাঁরা হাভানা আক্রমন করেন। ক্ষমতাচ্যুত হন বাতিস্তা। পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। এরপর ফিদেলের দেশ গড়ার পালা।

দেশ পরিচালনার দীর্ঘ সময়ে বহির্বিশ্বের বিশেষ করে মার্কিনী আগ্রাসন থেকে কিউবাকে রক্ষায় এক অসম লড়াইয়ে অবতীর্ন হন ফিদেল। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত তিনি দেশকে আগলে রাখেন ভালভাবেই।

ফিদেল তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনায় অনেক সময় অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব সিদ্ধান্তের সমালোচনায় হয়েছে। তবে একটা কথা ফিদেল বারবার বলেছেন, ‘আমাকে ঘৃনা করো, কোনো সমস্যা নেই। তবে দেশের কল্যানে যেসব সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই নিরিখে ইতিহাস আমাকে মার্জনা করবে।’

কাস্ত্রোর রাজনৈতিক দর্শন এমনই। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তিনি তাঁর কম্যুনিস্ট শাসনের নানা নীতির পরিবর্তন করেছেন। মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে কিউবা। তখন তিনি ভেনেজুয়েলার সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে সেই পরিস্থিতি সামাল দেন। এখনও কিউবার বড় অর্থনৈতিক সহযোগি হল ভেনেজুয়েলা। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিজের ট্রেডমার্ক জলপাই রঙের সেনা পোশাকের বদলে স্যুট-টাই পড়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। অনেকে মনে করেন, বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্য শুরুর ইঙ্গিত দিতেই ফিদেল ওই কাজ করেছেন। বর্তমান সময়ে গোটাবিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় ধুকছে, কিউবা কিন্তু নিজেকে সেই বিপদ থেকে ঠিকই রক্ষা করেছে। লন্ডনভিত্তিক নিউ-ইকোনোমিক ফাউন্ডেশনের মতে, কীভাবে বিরুপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হয় কিউবা তারই শ্রেষ্ঠ উদাহরন।

ফিদেলের শাসনকালে কিউবার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। লাতিন আমেরিকার মধ্যে এইচআইভি সংক্রমনের হার কিউবাতেই সবচেয়ে কম। পোলিও নির্মূল করা হয়েছে সেই ৬২ সালেই। এরপর ডিপথেরিয়া, হাম, মাম্পস রোগ নির্মূল করা হয়েছে। নিজের দেশের স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৪ হাজারেরও বেশি কিউবান বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কাজ করছে। জনসংখ্যার অনুপাতে দেশটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসকও রয়েছে। শিশুমৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণেও ঈর্ষনীয় সাফল্য লাভ করেছে কিউবা। বর্তমানে সেখানে শিশুমৃত্যুহার ওয়াশিংটনের চেয়েও অনেক কম। সর্বোপরি কিউবার স্বাস্থ্যসেবার মান সুইডেন ও সিঙ্গাপুরের সমপর্যায়ের। কিউবার এসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে মার্কিন তথা বহির্বিশ্বের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই। একজন ফিদেলের সুপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই।

মৃত্যুর আগের কয়েক বছরও কাগজে কলমে কিউবার ক্ষমতায় ছিলেন না ফিদেল। তবে দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ফিদেলের পরামর্শ নিয়ে কাজ করেছেন ভাই রাউল। রাউলের রাষ্ট্রপরিচালনার সকল মন্ত্রনা দিয়ে যেতেন ফিদেল। এখন ফিদেলকে হারিয়ে রাউল একা হয়ে গেলেন। মৃত্যুর কিছুকাল আগেও ফিদেল বড় আশাবাদ নিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই মিলে চললে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়া খুবই সম্ভব।’

তাঁর ওই স্লোগানের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাও অনুপ্রানিত হয়ে বলেছিলেন, ফিদেল পরমাণু অস্ত্র ও হানাহানি মুক্ত এমন একটি পৃথিবীর কথাই বলছেন যেটি কিনা সবার কাঙ্খিত।

ফিদেল ফিরে গেছেন কোটি মানুষের শান্তির ফায়সালা করে দিয়ে। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ছিল গোটা পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের মুখেই হাসি ফোটানোর মিশন। তিনি সেটা করে যেতে পারলেন না। বিপ্লবী মরে যায়, কিন্তু বিপ্লব মরে না। ফলে ফিদেলের দেখানো বিপ্লবের পথ সেই শান্তির পৃথিবীর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়ে যাবে কোটি কোটি তারুন্যকে। তারুন্যই একদিন গড়বে হানাহানি মুক্ত শান্তির সেই পৃথিবী। যে পৃথিবীর জন্য ফিদেল একদিন বিপ্লবের দীর্ঘ পথে হেঁটেছিলেন। আজ ১৩ আগস্ট তাঁর জন্মদিনে সেই প্রত্যাশাই দুনিয়ার শোষিত মানুষের।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট | email: lutforrahmanhimel@gmail.com

Link copied!