বাংলাদেশ পুলিশঃ মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগামী সম্মুখযোদ্ধা

মো. রফিকুল ইসলাম সুজন

ডিসেম্বর ৩০, ২০২১, ০৩:১৩ এএম

বাংলাদেশ পুলিশঃ মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগামী সম্মুখযোদ্ধা

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পশ্চিম পাকিস্তানি হায়নাদের পরাজিত করেই উদিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তিম লাল সূর্য। বাংলা ও বাঙালির আজন্ম লালিত স্বপ্ন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বপ্রথম যে বুলেটটি ছোড়া হয়, পাকিস্তানি হানাদারদের বুকে, সেটি ছিলো বাংলাদেশ পুলিশের ছোড়া বুলেট। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দুপুর ২টা থেকেই বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্-এ নানারকম সংবাদ আসতে থাকে যে, শহরের অবস্থা থমথমে ও আতঙ্কগ্রস্ত। সন্ধ্যা ৭ টায় খবর আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্ আক্রমণ হতে পারে। এ সংবাদে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের মধ্য শলাপরামর্শ ও তাদের করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। মূলত রাজারবাগে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশের স্বাধীনতাকামী মনোভাবের বহি:প্রকাশ ঘটতে থাকে মার্চের শুরু থেকেই, বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার আহ্বান সারা দেশের পাশাপাশি রাজারবাগের পুলিশদের প্রকাশ্যে ও গোপনে স্বাধীনতার জন্য কাজ করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে তোলে। রাজারবাগ পুলিশের এ ধরনের কর্মকান্ডে মেনে নিতে পারতো না স্বাধীনতাবিরোধী অবাঙালি পুলিশেরা। এ জন্য বাঙালি আর অবাঙালি পুলিশের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে  থাকতো সবসময়। এ জন্য স্বাধীনতাকামী পুলিশ সদস্যরা নির্জন কোথাও বসে আলোচনা করে নিতো তাদের কর্ম-পরিকল্পনা সম্পর্কে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দুপুরে পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্বপাকিস্তানের মধ্য আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে দায়িত্বরত পুলিশরা নিশ্চিত অনুমান করে চূড়ান্ত যুদ্ধ আসন্ন। তাই অনেক ফোর্স ক্লোজ হওয়ার নির্দেশনা না পেয়েও নিজে থেকে রাজারবাগে ফিরে আসে। সন্ধ্যার আগে থেকেই চরম উত্তেজনা বিরাজ করে রাজারবাগে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যে পুলিশ বাহিনীর প্রতি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।

স্বাধীনতার অন্বেষণে পাগল পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তখন অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে রাত ১১:২০ এ পাকবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনের পুলিশ বেতার মারফত প্রেরণ করা হয়। সংবাদটি ছিলো-“Base for all stations of “East Pakistan police, Keep listening, watch, we are already attacked by the pak army. Try to save yourself.

রাত আনুমানিক ১২টা, স্বাধীনতার স্লোগানে তখন কাঁপছিলো রাজারবাগের আকাশবাতাস। এরই মধ্যে সার্জেন্ট মুর্তজাসহ বেশ কয়েকজন সালামি গার্ডের স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। চিরাচরিত নিয়মানুসারে সকলে মিলে জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করে। তারপর তারা বেরিয়ে যায় সালামি গার্ডর চত্বর থেকে। এরই মধ্যে পুলিশ লাইনস্রে দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে প্রথম গুলিবর্ষণ হয়। ব্যারাকের ছাদে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও পাক সেনাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। ইতিহাসে সূচনা হয় একটি নতুন অধ্যায়ের। বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মরণপন প্রতিরোধে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাক বাহিনী। একটু পর মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলি শুরু করে পিআরএফ এর ৪টি ব্যারাক পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর সংখ্যা ছিলো প্রায় আটশো। রাত ৩:৩০ পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চলে। এক সময় আক্রমন থামে, বন্দি হয় দেড়শো বাঙালি পুলিশ। তার আগেই কিছু বাঙালি পুলিশ রাজারবাগের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে রাজারবাগ ত্যাগ করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্রে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে। সেই রাতেই তুমুল যুদ্ধে ১৫০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। ২৯ মার্চ ১৯৭১, পুলিশ সদস্যরা জীবন বাজি রেখে তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে নিরাপদে সীমান্ত পার করে ভারতে পাঠিয়ে দেন।

১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনার প্রদান করেন তৎকালীন ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ। আইজিপি আব্দুল খালেক পুলিশ সদস্যদের প্রতি খোলা চিঠি লিখেন-যার ভাষা ছিলো- “আমরা পুলিশ, অস্ত্র কিভাবে চালাতে হয় আমরা জানি। আমরা বাংলাদেশের সন্তান, আমরা বাঙালি, আমরা পুলিশ বাহিনী: আমরা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে আমরা জীবন উৎসর্গ করর……….”। এই চিঠিটি সহস্র পুলিশ সদস্যকে দেশের তরে জীবন দিতে উৎসাহিত করেছিলো। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১২৬২ জন পুলিশ সদস্য আত্মদান করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্য পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বহমান থাকবে ততদিন মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের অবদান অম্লান থাকবে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতা লাভের পরেও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশ পুলিশ সরকারের নির্দেশে জনগণের দ্বারপ্রান্তে সরকারি ত্রাণ ও সাহায্য সহযোগিতা পৌঁছে দেন এবং দুর্ভিক্ষগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসা সহযোগিতা প্রদান করেন। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বাংলাদেশের বন্যাকবলিত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সরকারি ত্রাণ পৌঁছে দেন এবং রাস্তাঘাট সামাজিক অবকাঠামো সংস্করণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বাংলাদেশ পুলিশ।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বাংলাদেশের গর্বিত পুলিশ বাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি সদস্য রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর। শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশের একচ্ছত্র অংশগ্রহণের ফলে বাংলাদেশ সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পুলিশ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে চলছে।

প্লাজমা যোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ সর্বপ্রথম বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের প্লাজমা প্রদান করে ইতিহাসে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। এই করোনাযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ তাদের জীবন বাজি রেখে করোনা রোগীদের চিকিৎসা, সচেতনতামূলক প্রচারণা, খাদ্য, পরিবহন সুবিধা ও আর্থিকভাবে জনগণকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশের নতুন এক মানবিক রূপ দেখেছে বাংলাদেশের জনগণ।  

তোমরা বেঁচে থাকবে এদেশের লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে, দূর আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে”।

 লেখক: প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!