মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্যাঁচার পাঁচালী

আনিস আলমগীর

এপ্রিল ১৩, ২০২২, ১০:৩৮ পিএম

মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্যাঁচার পাঁচালী

আমি যখন কলাম লিখি, সেটা আমার নিজস্ব মতামত, রিপোর্টিং না। আপনার মতামতও না। সেটা আপনি গ্রহণ করতে পারেন, বর্জন করতে পারেন। সমালোচনাও করতে পারেন। পক্ষে বা বিপক্ষে যেটাই হোক তাকে আমি কমপ্লিমেন্ট হিসেবে দেখে আসছি। কিন্তু সমালোচনার নামে যদি আমার নামে পোস্ট দিয়ে, ব্যক্তিগত আক্রমণ, গালিগালাজের হাট বসানো হয়— সেটার উদ্দেশ্য যে অন্য কিছু সেটা সবাই বুঝে। 

ধর্ম ও বিজ্ঞান বিতর্কে যেদিন আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং দেশটির কয়েকজন রাজনীতিবিদের অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তার একটি ইয়ার্কি ছবি প্রকাশ করি, শংকর মৈত্র এবং দুর্জয় রায় নামের চিহ্নিত দুই হিন্দু মৌলবাদী আমার ৬ দিন আগের এক কলামের সমালোচনা শুরু করে। কারণ, এরা মনে করে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরাই শুধু বিজ্ঞান বিরোধী। অথচ এরা জানে না আলিয়া মাদ্রাসায় এখন বিজ্ঞান পড়ায়। তাদের ছাত্ররা বিশ্ব বিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিক্যালে চান্স পাচ্ছে।

ফেইসবুকে সারাক্ষণ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর জন্য এই দুই কমিউনালকে আমি ব্লক মেরেছিলাম বহু আগেই। সর্বধর্মীয় মৌলবাদীদের ক্ষেত্রে আমি তাই করি, তাদের বিষবাষ্প থেকে মুক্ত থাকতে। আমার লেখালেখি নিয়ে ধর্মান্ধ ছাগু এবং পাঁঠারা পোষ্ট দিলে আমার দুটি লাভ হয়। হিংসার বিষবাষ্প নিয়ে যারা সেখানে কমেন্ট করতে, লাইক মারতে এগিয়ে আসে তাদেরকে চিহ্নিত করতে পারি দূরত্ব বজায় রাখার জন্য। আরেকটা হচ্ছে অসংখ্য ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, ফলোয়ার আসতে থাকে।

যা হোক ধর্ম এবং সংস্কৃতি নিয়ে আমার সেই কলামে সৌদি আরব এবং ইরানের উদাহরণ দিয়ে পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে আমি লিখেছিলাম:

এরা আমার অবস্থান বাদ দিয়ে আমার ধর্ম নিয়ে টানাটানি করে আর শুধু প্যাঁচা প্রসঙ্গ নিয়ে আসে।

প্যাঁচা প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম,

 

ব্যক্তিগতভাবে প্যাঁচা নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই। আড়ং পাট দিয়ে কারুশিল্পীদের বানানো প্যাঁচা বিক্রি করে, ঝুনঝুনি ওয়ালা ওই প্যাঁচা আমার বাসার ওয়ালে বছরের-পর-বছর ঝুলেছে, বাড়ি বদল করতে গিয়ে এখন হারিয়ে গেছে। আড়ং এর এই সামগ্রী আমি দেশের বাইরে গেলে বিদেশি বন্ধুদের জন্য নিয়ে যাই। কিন্তু এই লক্ষ্মী প্যাঁচা নিয়ে দুই হিন্দু মৌলবাদীর চুলকানিতে আমার মনে হচ্ছে আমাদের সার্বজনীন উৎসবগুলোকে মুসলিম মৌলবাদীরা যেমন অনৈসলামিক বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে, হিন্দু মৌলবাদীরা তেমনি এটাকে বাঙালি উৎসবের নামে তাদের ধর্মীয় উৎসবে পরিণত করার চেষ্টায় আছে।

এই মূর্খরা ভেবেছে প্যাঁচা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলেছি শুধু শুধু, অথচ আজ থেকে ১২/১৫ বছর আগে প্যাঁচার প্রতিবাদে পত্রিকায় বিবৃতি দেখেছি। ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে পহেলা বৈশাখকে কীভাবে বিতর্কিত করা হচ্ছে তার একটি সুন্দর বর্ণনা এগার বছর আগে লিখেছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ধারার জনপ্রিয় ছাত্রনেতা মাসুদ রানা, তার ফেইসবুকে। 

মাসুদ রানা লিখেছেন, ‘পয়লা বৈশাখের ধর্মনিরপেক্ষ ও সর্বজনীন নববর্ষ-উৎসবে যে মঙ্গল-প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে কিংবা সৌভাগ্যের হিন্দুদেবীর বাহন লক্ষ্মী-পেঁচার প্রতিকৃতি বহন করা হচ্ছে, এগুলো ধর্মীয় প্রতীক। ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহারের দার্শনিক ও রাজনৈতিক পরিণতি কী, তা বাঙালীর ইতিহাস থেকেই শিক্ষণীয়। সর্বজনীন সমাবেশে ও কর্মে ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহার মানুষকে সেক্যুলারিজম ও র‍্যাশনালিজমের জায়গা থেকে অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাসের জায়গায় ঠেলে দেয়। অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস যেহেতু সম্প্রদায়গতভাবে ভিন্ন-ভিন্ন ও ইরিকন্সাইলেবল, তাই সর্বজনীন আয়োজন তখন সাম্প্রদায়িক বিভক্তিতে পতিত হতে বাধ্য।

বৈশাখী উৎসবে ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহার চলতে থাকলে, এক সময় তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। এবং তা হবে ভয়াবহ। এখনও সময় আছে, ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারকে সক্রিয়ভাবে নিরুৎসাহিত করুন। তা নাহলে, পয়লা বৈশাখের নববর্ষ উৎসবের বিরুদ্ধে যে ইসলামিক মৌলবাদী প্রচারণা আছে, তার মূলে জল সিঞ্চিত হবে। বাইরে থেকে ইসলামী মৌলবাদীদের আঘাত বৃদ্ধির সাথে-সাথে ভিতর থেকেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট ও তীব্রতর হবে। শেষ পর্যন্ত বাঙালীর গর্ব করার মতো একমাত্র সেক্যুলার ঐতিহ্যিক উৎসবটি বিতর্কিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমার ধারণা, হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের পিছনে মুসলমান ব্যাকগ্রাউণ্ডের কিছু অতি উৎসাহী ‘সেক্যুলার’ লোক আছেন, যাঁরা সমাজের সংখ্যাগুরু ধর্মীয় ধারার বিপরীতে সংখ্যালঘু ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে প্রবলের প্রতি বিদ্রোহ এবং দুর্বলের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করেন। আমরা ব্রিটেনেও দেখেছি, মেইন স্ট্রীমের ক্রিশ্চান ব্যাকগ্রাউণ্ডের কিছু সেক্যুলার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মুসলমানদের প্রতি দরদ দেখাতে ‘আস্‌সালামুয়ালাইকুম’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইসলামিক শব্দ-প্রতীক ও রীতি-নীতি ব্যবহার করেন। ভারতেও দেখা যায় হিন্দু ব্যাকগ্রাউণ্ডের সেক্যুলার লোকেদের মধ্যে ইসলামিক শব্দ-প্রতীক ও রীতি-নীতি অনুকরণ করার একটা প্রবণতা।

অতি উৎসাহী সেক্যুলার লোকদের উদ্দেশ্য হয়তো খারাপ নয়। কিন্তু তাঁদের বুঝা উচিত, এ-রকম চর্চার সাথে সেক্যুলারিজমের কোনো সম্পর্ক নেই। সেক্যুলারিজম বলতে বুঝায়, সমস্ত অতিপ্রাকৃতিক সত্তার অস্বীকৃতি। মঙ্গলার্থে প্রদীপ জ্বালানো কিংবা লক্ষ্মী-পেঁচা বহনের মধ্যে এক ধরণের অতিপ্রাকৃতিক সৌভাগ্য-প্রত্যাশা নিহিত। এগুলো সেক্যুলারিজমের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ‘আল্লাহ’র সাথে ‘ভগবান’ মিলানো, কিংবা ‘রাম’ নামের সাথে ‘মুহম্মদ’, কিংবা ‘চার্চ’ ছেড়ে ‘মসজিদ’ ভিজিট করাকে সেক্যুলারিজম বলে না। এটি হচ্ছে মাল্টি-থিওক্র্যাসি বা বহু-ধর্মবাদ।

রাষ্ট্রে মাল্টি-থিওক্র্যাসির নীতি সমাজে ধর্মীয় প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে। আর, একবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলে, জয় শক্তিমানেরই হয়। সুতরাং সৎ-উদ্দেশ্য নিয়েও যাঁরা বহু-ধর্মবাদের চর্চা করেন, তাঁরা মূলতঃ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই ডেকে আনেন। তাই, বাংলাদেশের পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিভ্রান্তিকর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’ তত্ত্ব তাঁকে ইসলামিক ফাউণ্ডেশন তৈরি অনুমোদনে, পাকিস্তানে ইসলামিক সম্মেলনে যোগদানে এবং তাঁর মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত সংবিধানে কুরআনের বাণী অন্তর্ভুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত জাতির পরিচয় ‘বাঙালী’র বদলে ‘বাংলাদেশী’তে পর্যবসিত হয়েছে। এখন শুনছি, কুরআন-সুন্নাহ’র প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি!’

সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

Link copied!