রাজনীতিক হিসেবে আসহাব উদ্দীন ছিলেন গণমানুষের নেতা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ২৮, ২০২২, ০৩:০২ পিএম

রাজনীতিক হিসেবে আসহাব উদ্দীন ছিলেন গণমানুষের নেতা

লেবাননের কবি কাহলিল জিবরান ‘শিক্ষক’ নামক কবিতায় একজন শিক্ষককে একজন জ্যোতির্বিদের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলছেন, ‘একজন জ্যোতির্বিদ তোমার সাথে মহাকাশ সম্পর্কে তাঁর অর্জিত বিদ্যা নিয়ে কথা বলতে পারবেন, কিন্তু সেই বিদ্যা তোমাকে দান করতে পারবেন না।’ আসহাব উদ্দীন আহমদ সেরকম কয়েকজন শিক্ষকের সান্নিধ্যে পেয়েছিলেন যা পরবর্তী জীবনে তাঁকে  শিক্ষক হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আসহাব উদ্দীন আহমদের পারিবারিক নাম আসহাব মিয়া। তিনি পড়ালেখা শুরু করেছিলেন বাঁশখালীর নিজ গ্রামের মক্তব ও স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে। তারপর বাণীগ্রাম সাধনপুর স্কুলে। স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একজন স্কুল পরিদর্শক আসেন। তাঁর নাম আসহাব মিয়া জানতে পেরে পরিদর্শক ভদ্রলোক পরামর্শ দিয়েছিলেন মিয়া’র পরিবর্তে আসহাব উদ্দীন আহমদ লিখতে। তিনি যে শিক্ষক হবেন সেই মন্ত্র মনে বপন করে রেখেছিলেন স্কুলবেলা থেকে। যে পরিদর্শক তাঁর নাম বদলে দিয়েছিলেন তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘জীবনে কি হতে চাও?’ আসহাব উদ্দীন সাহসের সাথে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি একজন শিক্ষক হতে চাই।’ মোহাম্মদ আলম চৌধুরী রচিত ‘আসহাব উদ্দীন আহমদ ও মানবসমাজের মুক্তিভাবনা’ পড়ে জানা যায় ‘একজন শিক্ষক হতে চাই’-এই উত্তরের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁকে বকাবকি করেছিলেন কারণ প্রচলিত রীতিতে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হব না বলে তিনি শিক্ষক হওয়ার বাসনা পোষণ করেছিলেন।

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন আসহাব উদ্দীন আহমদ। কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স পাস করে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষের কাছে গিয়েছিলেন একটি প্রশংসাপত্রের জন্য। রায় বাহাদুর পদ্মিনীভূষন ছিলেন তখন কলেজের অধ্যক্ষ। তাঁর ইচ্ছে ছিল কোনো হাইস্কুলে পড়াবেন। অন্য একজন শিক্ষক অসুস্থ থাকায় তাঁর কপাল খুলে যায়। চট্টগ্রামে কলেজের ইংরেজি বিভাগে চাকরি হয়ে যায় তাঁর।

আপাদমস্তক নীতিবান এই ব্যক্তির পক্ষে বেশি দিন কলেজে চাকরি সম্ভব হয়নি। কলেজের অধ্যক্ষের অনিয়মের প্রতিবাদ করে চাকরি হারিয়ে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে যোগ দেন। বিপ্লবী চেতনার এই শিক্ষক পরে ফেনী কলেজ, লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা করেন। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ানোর সময় তার এক সহকর্মীর মাধ্যমে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। এই সময়ে ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। ইস্ট বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র ‘ দি টিচার’ সম্পাদনা করতেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে নিবিড় সম্পৃক্ততার সুবাদে একসময় শিক্ষকতা ছেড়ে পূর্ণকালীন রাজনীতিবিদ পরিণত হন। তাঁর শিক্ষকতা জীবন ছিল সরল-গরল অভিজ্ঞতায় ভরপুর। পাঠ্যবই বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় ‘মেইড ইজি’ পড়ার প্রবণতাকে ব্যঙ্গ করে তিনি লিখেন ‘মেইড ভেরি ইজি’ নামে একটা রম্য পুস্তিকা।

১৯৫৪-১৯৫৭ পর্যন্ত সময়ে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বাঁশখালী আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। বাঁশখালীর সাথে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনন্য। দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারে তিনি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ, সাতকানিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাই স্কুল, পশ্চিম বাঁশখালী হাই স্কুল ও বাহারছড়া রত্নপুর হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজনীতিক হিসেবে আসহাব উদ্দীন ছিলেন গণমানুষের নেতা। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে মাওলানা ভাসানীর সাথে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপে যোগদান করেন। কৃষকদের দুর্দশা দূর করার জন্য আজীবন লড়ে গেছেন আসহাব উদ্দীন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষকদের সংগঠিত করেন তিনি।

 

যে রাজনীতির জন্য আসহাব উদ্দীন শিক্ষকতা ছেড়েছিলেন সেখানে তিনি তাঁর মনোবাসনা পূরণ করতে পারেননি। মনোবেদনা নিয়ে তিনি রাজনীতি ছেড়েছেন আশির দশকে। রাজনীতি ছাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বোকার ফসল পোকায় খায়। এটা একটা সর্বজন স্বীকৃত প্রবচন। পার্টির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা পোকারা বোকাদের উৎপাদিত ফসল খেয়ে মোটা-তাজা, নাদুসনুদুস হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসে মোচে তা দিচ্ছে। এ ধরনের রাজনীতিকেরা ত্যাগী কর্মীদের মই হিসেবে ব্যবহার করে নেতা বনে যায়। নেতৃত্বের বা মন্ত্রিত্বের গদিতে সমাসীন হয়ে মইটি পায়ে ঠেলে নিচে ফেলে দেয়।’

তিনি নিজেকে আত্মস্বীকৃত ‘বোকা মিয়া’ মনে করতেন। ‘বোকা মিয়ার ইতিবৃত্ত’ নামে তাঁর বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার মতো সরল মানুষের জন্য রাজনীতি নয়। আমি যেন পথ ভুলে রাজনীতিতে এসেছি। আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনকে একটা দুঃস্বপ্ন মনে হতে লাগল।’

শেখ সাদীর একটা প্রবাদ আছে তিনটি বস্তু ব্যতীত ব্যক্তি টিকে থাকতে পারেন না—বিদ্যাচর্চা, ব্যবসা ও রাষ্ট্রশাসন। রাজনীতিতে মোহভঙ্গের কারণে হতাশ হলেও আসহাব উদ্দীন নিজেকে গুটিয়ে নেননি মানবসেবা থেকে। বেছে নেন লেখালেখি। তাঁর মনে হতে থাকে হেনরি ডেভিড থরো সেই উক্তি, ‘সমাজের একজন ব্যক্তিকেও যদি অন্যায়ভাবে জেলে নেওয়া হয়, বিবেকবান মানুষের কাছে পুরো সমাজটাকেই জেল মনে হয়’—ধ্রুব সত্য। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৬। অধ্যাপক আলম চৌধুরী তাঁর বইয়ে আসহাব উদ্দীনের সাহিত্যচর্চার প্রশংসা করে বলেন, ‘বাস্তবতার নির্দয় কামড় তাঁর বিবেককে লিখতে প্ররোচিত করে। তাই তিনি প্রথাগত সাহিত্যিকদের ছায়ারূপ থেকে সরে এসে নিজস্ব শৈলীতে লিখেছেন। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।’ নিজের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে আসহাব উদ্দীন আহমদ বলেন, ‘রীতিমতো সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায়, আমি তা নই, খেয়ালের চাপে লিখি। খেয়াল না চাপলে মাথায় লাঠির বাড়ি মারলেও কলম দিয়ে কিছু বের হয় না।’ আসহাব উদ্দীনের সাহিত্যচর্চা মূলত বিবেকের তাড়নায়, সমাজে প্রচলিত সংস্কার, কুপ্রথা ও অনাচারের বিরুদ্ধে স্লোগান। আমেরিকার সাহিত্যিক ও দার্শনিক এমারসন ও হেনরি ডেভিড থরোর রাজনৈতিক দর্শনের সাথে তাঁর ভাবনা ও চিন্তার মিল পাওয়া যায়। অবশ্যই অনেকে তার লেখালেখিকে শুধু রম্য আর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। তিনি নিজে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ‘আমার লেখায় হাসি- ঠাট্টার ভেতর দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অবিচারকে তুলে ধরা হয়েছে এবং জনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রচার করা হয়েছে, প্রোপাগান্ডা আকারে নয়, সাহিত্যরূপে।’

এই শিক্ষক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিক ১৯৯৪ সালের ২৮ মে মারা যান। কাজী নজরুল ইসলামের মতোই শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নিজেরই প্রতিষ্ঠিত বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

দার্শনিক থমাস হবসের মতে, ‘পৃথিবীতে স্বল্পসংখ্যক মানবিক ও সৃষ্টিশীল মানুষ জন্মগ্রহণ করে; যারা নিজের স্বার্থকুন্ডলিতে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে অপরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মতো উদারতা দেখাতে পারে।’ আসহাব উদ্দীন এমন একজন ব্যক্তি। শিক্ষকতা, রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চা এই তিনের অপূর্ব সমন্বয় তাঁর জীবন। বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। তাঁর রচনা ও জীবনদর্শন পৌঁছাতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের করণীয় কী জানতে আসহাব উদ্দীন আহমদের সাহিত্যপাঠ জরুরি। আঠাশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান পুরুষকে স্মরণ করছি প্রার্থনা ও ভালোবাসায়।

Link copied!