সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: অক্লান্ত প্রগাঢ় জ্ঞানপথিক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ২৬, ২০২১, ১০:৩৫ পিএম

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: অক্লান্ত প্রগাঢ় জ্ঞানপথিক

স্থান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিন বছরের জন্য বিলেতে এসেছেন কলকাতার এক অধ্যাপক। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। উদ্দেশ্য গবেষণা করে ডি. লিট (Doctor of Literature) পাওয়া। কিন্তু বাধ সাধলেন থিসিস বোর্ডের লোকজন। জানিয়ে দিলেন, ‘আগে পিএইচডি, পরে ডি. লিট।’

বিলেতে সেই সময় রামশর্মা তর্কবাগীশের ‘প্রাকৃত কল্পতরু’ সম্পাদনা করছেন এক পণ্ডিত। তা করতে গিয়ে বেশ কিছু জায়গায় অর্থ ও পাঠ উদ্ধারে বড় সমস্যা হচ্ছে। ছুটে গেলেন সেই বাঙালি অধ্যাপকটি। কাজ মিটল। খুব খুশি সেই বিলেতি পণ্ডিত। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ দেশে কী করতে?’ সমস্যার কথা জানালেন কলকাতার যুবক। শুনেই সেই পণ্ডিতের উক্তি, ‘তুমি যে আমার বইয়ের পাঠোদ্ধার করে দিলে, তাতেই তো পিএইচডি হয়ে গেল। আবার কেন?’ এর পরে সেই পণ্ডিতের সুপারিশেই যুবকটি ডি. লিট এর জন্য ভর্তি হলেন।

এই বিরল প্রতিভার বাঙালি অধ্যাপক হলেন ‘ভাষাচার্য’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন যথার্থই জ্ঞানতাপস এবং তার জ্ঞানানুসন্ধান আমৃত্যু অব্যাহত ছিল। ভাষাতত্ত্ব ও ভাষা বিজ্ঞান ছাড়াও সঙ্গীত, চিত্রকলা প্রভৃতি বিষয়েও তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুনীতিকুমারকে ‘ভাষাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এর থেকে বড় সম্মান আর কী হতে পারে কোনো মানুষের জীবনে?

zz

কবিগুরুর সঙ্গে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার। বয়সের ব্যবধান প্রায় তিরিশ,অথচ রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পান্ডিত্যকে অত্যন্ত সম্মান করতেন৷ ভাষা সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নের মীমাংসার জন্য রবীন্দ্রনাথের বড় আস্থাভাজন ছিলেন সুনীতিকুমার। আবার তিনি রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল মনীষাকে শ্রদ্ধা করতেন হৃদয় দিয়ে৷ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সুনীতিকুমার বলেছেন, ‘last great expression of World literature for the present age’ ৷ তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে স্বদেশের ও বিশ্বমানবতার সম্পদ।

তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মালয়, সুমাত্রা, বালিদ্বীপ, যবদ্বীপ, শ্যামদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন৷ সেই ভ্রমনের উৎকৃষ্ট ফসল ‘রবীন্দ্র সংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ’ পুস্তক৷ 

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৮৯০ সালের ২৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। অসম্ভব মেধাবী ছাত্রটি কলকাতা একাডেমি, মতিলাল শীলের অবৈতনিক স্কুল, স্কটিশ চার্চ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়— ধাপে ধাপে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার সব স্তরে সাফল্য অর্জন করেছিলেন৷ 

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কার্যত বাংলা ভাষার ঠিকুজি নির্ণয়ের মত কঠিন কাজটি করেছেন দক্ষতা ও মুন্সিয়ানার সঙ্গে৷ ১৯১৯ থেকে ১৯২১ এই দু’বছরে এমন কঠিন কাজ শেষ করা কেবল কঠিন নয় অসম্ভব বলে স্বীকৃত বিদগ্ধ মহলে৷ যদিও বাংলাভাষা সম্পর্কে তাঁর গবেষণা করার চিন্তা মাথায় এসেছিল আরও একযুগ আগে – এম.এ. পড়ার সময়। 

Suniti.2

ইংরেজি ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আধুনিক পদ্ধতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাংলা ভাষাও ইংরেজির মত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই কারণে ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ করার সম্ভাবনার কথা ভেবে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন,এবং সাফল্য পেয়েছিলেন৷

বাঙালি মনীষা সুনীতিকুমারের ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ প্রকৃত অর্থেই একটি মহাগ্রন্থ। বাংলাভাষার ইতিহাস, গঠন বৈশিষ্ট্য ও ব্যাকরণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বাঙালির ইতিহাস, ভূগোল ও মানস-সংস্কৃতিরও পরিচয় তুলে ধরেছেন গ্রন্থটিতে৷ 

বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু তার। ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ের অধ্যাপনা। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্বনিবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা, ১৯২১ সালে ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি লাভ করেন।

রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন সুনীতিকুমার। লন্ডনের সোসাইটি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের সদস্য পদ লাভ করেছেন ১৯৫০ সালে৷ ১৯৫২-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের অধ্যক্ষ পদ সামলেছেন৷ ‘পদ্মবিভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা পেয়েছেন এবং সাহিত্য একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন৷

ভাষাতত্ত্ব, প্রাচ্যবিদ্যার প্রতিনিধি হিসেবে সুনীতিকুমার বারবার গিয়েছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, আফ্রিকা, চিন, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর্মেনিয়া। লন্ডনে আন্তর্জাতিক ধ্বনিবিজ্ঞান সংস্থার সভাপতিও হয়েছেন। প্রাচ্যবিদ্যার বক্তৃতা দিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড, এমআইটি-র মতো বিদ্যাচর্চার শ্রেষ্ঠ স্থানগুলোতে। 

আজ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিবস। বাংলাভাষার ইতিহাস গবেষণায় ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জন্মদিবসে তার প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা।

Link copied!