সৈয়দ আশরাফ: নির্লোভ এক রাজনীতিকের প্রতিচ্ছবি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ৩, ২০২৩, ০৮:০১ এএম

সৈয়দ আশরাফ: নির্লোভ এক রাজনীতিকের প্রতিচ্ছবি

রাজনীতিতে সততা আর বিশ্বাস কখনও পরাজিত হয় না। সমকালীন রাজনীতিতে আমি এটা দেখেছি সৈয়দ আশরাফের জীবনে। তাঁর প্রয়াণের পর তিনি আরও বেশি করে উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন। আরও আলোচ্য হয়ে উঠছেন। আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।

আশরাফ শব্দের অর্থ উচ্চস্তরের মানুষ, অভিজাত বংশের মানুষ, মানে নিপাট ভদ্রলোক। আর আতরাফ শব্দের অর্থ অনভিজাত, ইতরবিশেষ শ্রেণির মানুষ ইত্যাদি। অনেকে বলে থাকেন ''নামে কীইবা আসে যায়।'' কথাটা হয়ত সব সময় সঠিক নয়। নামেও মাঝেমধ্যে আসে যায়। না হলে সৈয়দ আশরাফ, যাঁর পুরো নাম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তিনি সত্যি সত্যি ‘আশরাফ’ বা অভিজাত হবেন কেন। এই সৈয়দ আশরাফ মানে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফ। যাঁর আর বিস্তারিত পরিচয় দেবারও দরকার পড়ে না। নাম বললেই সবার মনের পর্দায় নিরহংকারী, নির্লোভ আর নিপাট ভদ্র একজন রাজনীতিকের ছবি ভেসে উঠে। এমনটা নয় যে শুধু নিজ দলের মানুষজনের কাছেই তিনি এমনভাবে পরিচিত ছিলেন, অন্য দলের নেতাকর্মীদের কাছেও তিনি তার জীবিতকালে শ্রদ্ধার্হ ছিলেন। কারণ, সৈয়দ আশরাফ যে একজনই ছিলেন। দেশের সৎ রাজনীতিকের আকালের কালে বহু আতরাফ রাজনীতিক দেখি আমরা, সেই আঁধারকালে আশরাফ ছিলেন সত্যিকারেই ‘আশরাফ রাজনীতিক’।

সৈয়দ আশরাফ একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ। মাতৃভূমি, দেশের সার্বভৌমত্ব, বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আদর্শ, দল ও নেত্রীর প্রতি অকুন্ঠ অনুগত একজন ছিলেন। ভোগ বিলাসী রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির এই মহামারিকালে হাতে গোনা যে'কজন রাজনীতিবিদ মোহমূক্ত আদর্শিক রাজনীতি লালন করে গেছেন, নিঃসন্দেহে সৈয়দ আশরাফ তাঁদের অন্যতম ছিলেন। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, প্রচার, সংবাদ শিরোনাম— কোনো কিছুই তাঁকে কোনোদিন মোহাবিষ্ট করতে পারেনি। এরকম রাজনৈতিক কর্মী যে কোনো দলের জন্যই সম্পদ। সম্পদ দেশের জন্যও।

সৈয়দ আশরাফ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন আপন ভূবনের মহারাজা। সেই মানুষটিই আবার রাজনীতির অঙ্গনে নেতার একান্ত এক অনুগত সহচর। নেতৃত্বের প্রতি অবিচল থেকে দল ও দেশের পাহাড়সম বিপদ থেকে অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সামলে নিয়েছেন এই ক্রাইসিস ম্যানেজার। একজন বড় নেতাও যে বিনয়ী, সভ্য, সৌম্য, নির্লোভ থেকে দেশ ও জাতির জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে গড়ে উঠতে পারেন, রাজনীতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে দার্শনিকের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন, সৈয়দ আশরাফ তাঁর নির্মোহ জীবনে সেই স্বাক্ষরটিই রেখে গেছেন। স্বল্পভাষী এই রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে প্রার্থনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাগাড়ম্বর নেই। সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা, একেবারে মেপে পেমে। রাজনীতিকে তিনি নিয়ে গেছেন অনুভবের পর্যায়ে। তাঁর একটি উক্তি এখনো তাই আওয়ামী লীগের অগণন অবহেলিত তৃণমূল কর্মীর হৃদয়ে অনুরণন তোলে: 'আওয়ামী লীগ এক অনুভূতির নাম।'

যে বছর তিনি চির বিদায় নিলেন, মানে সেই ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি, তখন তাঁকে নিয়ে একটি সুন্দর পোষ্ট ফেসবুকের নিউজফিডে ঘুরছিল বেশ ক’দিন ধরে। কল্পকাহিনীর মতো সেই পোষ্টটি। ক্যান্সার আক্রান্ত প্রিয়তম স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলেন! প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যও তিনি নেননি স্ত্রী ছোট হয়ে যাবেন ব’লে! চেপে রাখলেও খবরটা নাকি পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও চলে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর প্রতি বরাবরই অগাধ আস্থা রাখতেন। সে যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত সেই স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি আশরাফ। তবে স্বামী হিসেবে বন্ধুর মতো শেষ দিনটি পর্যন্ত স্ত্রীর পাশে থেকেছেন তিনি।

পোস্টটির সত্যতা কতটুকু জানি না। যাচাই করতেও যাইনি কোনোদিন। দরকারও যে পড়ে না। সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে এরকম যদি শতসহস্ত্র কাহিনীও ছড়িয়ে যায়, সেসবের সবগুলোই বিশ্বাস করতে মন চাইবে আমার। কারণ মানুষটি যে সৈয়দ আশরাফ। অনেকে তখন বলেছেন, ঢাকায় তাঁর নাকি বাড়িও ছিল না! এই তথ্য ত আরোও বেশি হৃদয় বিদীর্ণকারী! যেখানে একজন সামান্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরও একাধিক বাড়ি-গাড়ি, নেতাদেরও ডজনে ডজনে বাড়ি, বিদেশের ব্যাংকে শত কোটি টাকা, সেখানে এমন বিশাল নেতার ঢাকায় বাড়ি নেই— এমন তথ্য এ দেশে বিরল এক ঘটনাই বটে!

সৈয়দ আশরাফ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। একটি দলের সাধারন সম্পাদক, বিরাট এক পদ এ দেশে। সেই পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন— এমন তথ্য কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় না। কোনো পেপার-পত্রিকাতেও এমন খবর মেলে না। এটিও বিস্ময়কর এক ঘটনা এ দেশে! তার স্ত্রীও ছিলেন তেমনই একজন। একমাত্র মেয়েটিও থাকেন সব সময় অন্তরালে। এমন একটি রাজনৈতিক পরিবার সত্যিকারেই অভিজাত বা আশরাফ পরিবার না হয়ে পারে না। এমন পরিবারকেই হয়ত বলা হয় আদর্শ পরিবার।

এটা হয়তো নিয়তি নির্ধারিতই ছিল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের রাজনীতিতে আসা কোনো বিস্ময়কর ঘটনা ছিল না। খুব ছোটবেলায় এক আদর্শবাদী পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দেখে দেখে তিনি বড় হয়েছেন। শিখেছেনও হাতে-কলমে। ১৯৫২ সালের সময়কালটার কথাই ধরা যাক। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনে উত্তাল তখন পূর্ব পাকিস্তান। বছরখানেক আগে সরকারি চাকরি ছেড়ে বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম যোগ দিয়েছেন অধ্যাপনা পেশায়। শুরু করেছেন ওকালতিও। সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তখন রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একই বছর তার ঘর আলোকিত হয় এক পুত্র সন্তানের আগমনে। নাম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ছোট বেলাতেই সৈয়দ আশরাফ দেখেছেন রাজনীতিবিদ পিতার কল্যাণকর্মের ব্যস্ততা। সেই আদর্শ বাবার সন্তান সৈয়দ আশরাফও তাই আদর্শবাদী না হয়ে পারেননি।

ছোট বেলা থেকেই সৈয়দ আশরাফ দেখেছেন রাজনীতির জন্য কীভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। পিতাকে দেখে তিনি বুঝেছিলেন সততা আর বিশ্বাস কখনও পরাজিত হয় না। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই রাজনীতিতে অভিষেক হয় সৈয়দ আশরাফের। ছাত্রলীগেই তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। স্বাধীনতার পর তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকও। এর আগে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মহান মুক্তিযুদ্ধেও। ইতিহাস সরল পথে চলেনি তাঁর। কিন্তু তিনি ইতিহাসকেই বদলে দিয়ে গেছেন।

এমন রাজনীতিক পরিবারই দেশের মানুষের কাঙ্খিত। এ কারণেই দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা সৈয়দ আশরাফ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই বাক্যটি বলবেনই বলবেন: ‘সৈয়দ আশরাফের শরীরের পুরোটাই ছিল প্রিয় দল আওয়ামী লীগ, তাঁর শরীরে রক্ত-মাংস বলে আলাদা কোনো কিছু ছিল না!’

একটি আদর্শ রাজনৈতিক দলের জন্য এমন আদর্শবান ও নিবেদিত প্রাণ নেতার বিকল্প হয় না। এমন রাজনীতিক নিজ দলের জন্য যেমন আশির্বাদ স্বরূপ, তেমনি জাতির জন্যও কল্যাণকর। সৈয়দ আশরাফ তাই দেশের রাজনীতির জন্যই এক আশির্বাদ ছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এই মানুষটির একটি স্লোগান এখনও আমার মনে বাজে। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে সৈয়দ আশরাফের বলা সেই স্লোগানটি হল:

রাজনীতি করলে দুর্নীতি ছাড়েন

দুর্নীতি করলে রাজনীতি ছাড়েন

সৈয়দ আশরাফের ওই স্লোগানের সুর ধরে আমিও প্রায়শ: সাংবাদিক সহকর্মী, সতীর্থদের উদ্দেশ্যে বলে থাকি: সাংবাদিকতা করলে দুর্নীতি ছাড়ুন/ দুর্নীতি করলে সাংবাদিকতা ছাড়ুন। শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন না ক্লিন ইমেজের সৈয়দ আশরাফ, ছিলেন আপোষহীনও। এ কারণেই রাজনৈতিক অঙ্গনে সৈয়দ আশরাফ এক দুঃসাহসী নামও। এই বাংলাদেশে যতদিন থাকবে সৎ মানুষের রাজনীতি, ততদিন সৈয়দ আশরাফও থাকবেন গণমানুষের মনমন্দিরে। তাঁর জীবনাদর্শ দল ত বটেই, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্যও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে আরও বহু বহুকাল।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট। মেইল: lutforrahmanhimel@gmail.com

Link copied!