সৈয়দ শামসুল হক: সাহিত্যের সব্যসাচী পরিব্রাজক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২, ০৬:০৩ এএম

সৈয়দ শামসুল হক: সাহিত্যের সব্যসাচী পরিব্রাজক

“মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা/
মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা/
মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/
মানুষ আসতে আছে মহররমের ধুলার সমান…”।

কালজয়ী কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এর কয়েকটি লাইন। ১৯৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হওয়া একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী এই কাব্যনাট্যের রচয়িতা সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা এই সব্যসাচী লেখকের আজ প্রয়ান দিবস।   

বাংলা সাহিত্যের এমন কোনও শাখা নেই, যা সৈয়দ হকের সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ হয়নি। কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, গীতি কবিতা, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, শিশু-কিশোরসাহিত্য, সায়েন্স ফিকশন, সাহিত্য-কলাম, অনুবাদ, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনি, চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ —সব ক্ষেত্রেই তাঁর সদর্প পদচারণা। সাহিত্যের এই বহুমুখী বিচরণের জন্যই তাকে বলা হয় সব্যসাচী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতে, “রবীন্দ্রনাথের পরে সৈয়দ হকই একমাত্র বাঙালি সাহিত্যিক, যিনি সফলভাবে সাহিত্যের সব শাখায় স্বীয় অবদানের কারণে প্রবলভাবে আলোচিত ও সমালোচিত।...সৈয়দ হক যৌবনে এক অসাধারণ সাহসিকতার সঙ্গে পেশা হিসেবে লেখালেখিকেই বেছে নিয়েছিলেন। আমরা আশঙ্কা জানিয়েছিলাম, এটা কি সম্ভব হবে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তিনি সেটাকে সম্ভব করে ছেড়েছেন।”



শৈশবকাল ও পড়াশোনা

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্ম সৈয়দ শামসুল হকের। জন্মস্থান কুড়িগ্রামের মাইনর স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ হক ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গণিতসহ বিজ্ঞান বিষয়গুলোতে ভাল দখল থাকায় বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হোক। বাবার এই দাবি এড়াতে পালিয়ে বম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) পাড়ি দেন।

মুম্বাইয়ে একটি সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারি হিসেবে এক বছর চাকরি করার পর বাবার অনুরোধে ফিরে আসেন, ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। কলেজ জীবন শেষ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হলেও দুই বছর পর অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। পড়ালেখা শেষ না করেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'দেয়ালের দেশ'।



নিজস্ব সাহিত্যশাখা তৈরি করেছেন

আশি বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে সৈয়দ হক সব সময় সন্ধান করেছেন সাহিত্যের নতুন প্রকরণ। গল্পপ্রবন্ধ, গল্পপট, গাথাকাব্য-এর মতো নিজস্ব সাহিত্যশাখা তৈরি করেছেন। সাহিত্যকর্মের সমান্তরালে রচনা করেছেন স্মরণীয় কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য এবং কালজয়ী বাংলা গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভা বিস্তৃত হয়েছে চিত্রকর্মেও। নিজের বেশকিছু রচনার ইংরেজি অনুবাদও করেছেন তিনি।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সবচেয়ে কম বয়সে (২৯ বছর) বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখক শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ বাংলায় রূপান্তরসহ লিখে গেছেন তিনটি কবিতার বই, একটি গল্পের বই এবং ‘ভাবনার ডানা’ নামের ব্যতিক্রমী ভাবনাগুচ্ছ।



ভার্সেটাইল নাট্যকর ও সাহিত্যিক

ক্ষণজন্মা এই সাহিত্যিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত না করে পৃথিবীর পাঠশালায় শিক্ষিত হয়েছেন; আজ দেশ-বিদেশে তিনি নিজেই প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার বিষয়। সৈয়দ শামসুল হকের মঞ্চনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। তাঁর কাব্য ‘পরানের গহীন ভিতর’ বাংলা কবিতার অমৃত সম্পদ।

বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ তার সম্পর্কে বলেছেন, “নাট্যকার হিসেবেও সৈয়দ হক ছিলেন দারুণ সফল। বিশেষ করে তার রচিত দুটি কাব্যনাট্য ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলা নাটকে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে।”

‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মূলত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের পটভূমিকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা, ধর্ষণ, হত্যা, গ্রামীণ মোড়লের ভূমিকা, রাজাকারদের কর্ম, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ চেতনায়প্রেক্ষিতে মানবীয় আখ্যান। এখানে রাজাকার চরিত্রকে নায়ক বানিয়ে মূলত কালোর মধ্য দিয়ে সাদার অনুপস্থিতি বুঝানোর চেষ্টা করেছেন সৈয়দ হক। ‘পায়ের আওয়াজ’ আসলে মুক্তিপাগল মানুষের আওয়াজ। যে পদধ্বনি রাজাকার মাতব্বরদের মতো শোষকদের ভীত করে তোলে।



এই নাটকের বিষয়ে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, “পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে পাঠক ও দর্শকের কাছে চিহ্নিত হলেও, সবশেষে কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বলা দরকার যে—এ নাটক আমি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে রচনা করি নি; একাত্তর এ নাটকে একটি পরিচিত ও আমাদের প্রত্যেকের জীবন স্পর্শকারী পটভূমি মাত্র। আমি চেয়েছি এই মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করে আরো বড় একটি মুক্তির জন্যে দর্শককে প্রাণিত করতে—সে-মুক্তিযুদ্ধ ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মের নৌকোয় নৈতিক অন্যায়কে পার করিয়ে দেবার যুগ-যুগান্তরের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে।” (সূত্র: সৈয়দ শামসুল হক, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাট্যগ্রন্থ, চারুলিপি প্রকাশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৬৩)

নবীন কবিদের আইকন

সৈয়দ হকের কবিতার ব্যতিক্রমধর্মী ঢং পাঠককে দারুনভাবে পূলকিত করে। নবীন কবিদের আইকন ছিলেন তিনি। তাইতো কবি অধ্যাপক মোহাম্মদ সামাদ বলেন, “কবিতায় তার ধারাবাহিকভাবে যে অবদান তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সৈয়দ হককে অনুসরণ করে আমাদের কালের কবিরা বা তার পরবর্তী কালের কবিরা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন। তার ‘খেলারাম খেলে যা’ অনুকরণ করে আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ হকের অবদানকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।”

ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে সদম্ভ পদচারনা

সৈয়দ শামসুল হকের বড়গল্প ‘রক্তগোলাপ’ বিশ্বসাহিত্যের জাদুবাস্তব ধারার পথিকৃৎ সংযোজন। তিনি নগরজীবন ও নাগরিকদের জীবনচিত্র তুলে ধরেন তাস (১৯৫৪) গল্পগ্রন্থে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন এককালে ‘চরিত্রহীন উপন্যাস’ লিখে বাংলা সাহিত্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি সৈয়দ শামসুল হক ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন ‘খেলারাম খেলে যা’ (১৯৬২) উপন্যাস লিখে।

অনন্য গীতিকবি

সংগীত জগতেও তিনি অপ্রতিদ্বন্ধি গীতিকার হিসেবে পরিচিত সৈয়দ হক। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অনেক গান সৈয়দ হকের লেখা। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে গান লেখার মধ্য দিয়ে গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এই চলচ্চিত্রের সবগুলো গান তার লেখা। একই পরিচালকের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’র ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, সে কি তুমি নও, ওগো তুমি নও’ বেশ জনপ্রিয় হয়। ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বড় ভালো লোক ছিলো’ সিনেমার গান ‘তোরা দেখ তোরা দেখ দেখরে চাহিয়া’ এবং ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ সব শ্রেণির শ্রোতার মুখে মুখে আজও গানটি শোনা যায়। দুটি গানেই কন্ঠ দিয়েছেন লিজেন্ড প্লেব্যাকি সিংগার এন্ড্রু কিশোর।

‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ গানটি সম্পর্কে প্রয়াত এন্ড্রু কিশোর একবার বলেছিলেন, “ এই গানটা আমার জীবনের অবিস্মরণীয় গান। এই গানের জন্য আমি প্রথমবারের মত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই ১৯৮২ সালে।”

সাহসী সাংবাদিক

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে যেয়ে বিবিসি বাংলায় খবর পাঠক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি বিবিসিতে তিনিই পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার ভরাট কণ্ঠ ও সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন।



গান ছিল তার রক্তে

সৈয়দ শামসুল হক তার প্রয়াণের দুই দিন আগে হাসপাতালের কেবিনে গুণী কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরকে তার অপ্রকাশিত কিছু গানের দায়িত্ব দিয়ে যান। গানগুলো সুর করার জন্য আলম খানের কথা বলে যান। এরই মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের একটি গানের রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। গানটির শিরোনাম ‘অপ্রকাশিত সৈয়দ হক-১’



মৃত্যু

২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে সৈয়দ শামসুল হককে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়লে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেন। চার মাস চিকিৎসার পর ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Link copied!