হুমায়ুন ফরিদী: রক্তেই মিশে ছিল যার অভিনয়

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২, ২০২২, ১১:৩১ পিএম

হুমায়ুন ফরিদী: রক্তেই মিশে ছিল যার অভিনয়

কখনও নায়ক, কখনও বা খলনায়ক। শুধু এই দুই চরিত্রেই নয়, নানা বৈচিত্রময় চরিত্রেই তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এক তারকা অভিনেতা। অনেকের কাছে তিনি তারকাদের তারকা। ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। কিন্তু গোটা ক্যারিয়ারে তিনি ডুবেছিলেন অভিনয়ে। সেই বহুমাত্রিক অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর আজ প্রয়াণ দিবস।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে কয়েকজন অভিনয়শিল্পী মঞ্চ ও টিভি নাটককে জনপ্রিয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরিদী নিঃসন্দেহে ছিলেন তাদের শীর্ষস্থানীয়। জীবদ্দশায় তিন দশকেরও বেশি সময় চলচ্চিত্রেও সমান দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছেন নন্দিত ও বরেণ্য এই ভার্সেটাইল অভিনেতা।

ভাষা আন্দোলনের বছরেই ২৯মে পুরান ঢাকার নারিন্দায় জন্ম হুমায়ুন ফরিদীর। চার-ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় হুমায়ুন ফরিদী চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে (স্নাতক) ভর্তি হন। তবে পরের বছরই খাতা-কলম রেখে কাঁধে তুলে নেন রাইফেল, ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে দামাল ছেলের মতো লড়াই করেছেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে (স্নাতক) ভর্তি হন। মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই তার অভিনয় প্রতিভার বিকাশ ঘটে।

অর্থনীতির খটমটে তত্ত্ব’র পাশাপাশি  নাট্যতত্ত্বে দীক্ষা নেন। গুরু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা নাট্যকর সেলিম আল দীন।  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন। ঢাকা থিয়েটারের ‘শকুন্তলা’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’-এর মতো মঞ্চনাটকে জাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর অভিনয় দেখে নাট্য জগতের সবাই বুঝে ফেলেছিল নতুন ধূমকেতুর জন্ম হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন-একদিন শাসন করবে এই যুবক। সেদিনের হিসেব এক চিলতেও ভুল হয়নি। এরপর টানা তিন দশক হুমায়ুন ফরিদী তার ক্যারিশম্যাটিক, তার ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন বাংলা ছবিপ্রিয় জাতিকে।

নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা মঞ্চ- কোথায় নেই হুমায়ুন ফরিদী। সবখানেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। মঞ্চের গণ্ডি পেরিয়ে টিভি নাটক আর চলচ্চিত্রেও দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করেছেন হুমায়ুন ফরিদী। ১৯৮০ সালে ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এর মাধ্যমে টিভিনাটকে অভিষেক হুমায়ুন ফরিদী। দুই বছর পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘নীল নকশার সন্ধ্যায়’ ও ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ নাটকে অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। তার অভিনীত ধারবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ আজও দর্শকের স্মৃতির পাতায় ভাস্বর। এতে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি।

ফরিদীর নাট্যাভিনয় থেকে চলচ্চিত্রে আসা ছিল অনেক নাটকীয়। দেশীয় চলচ্চিত্রের তখনকার বেহাল অবস্থা দেখে রূপালি পর্দার জন্য কাজ করবেন কিনা এ বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সুবর্ণা মুস্তাফার অকুণ্ঠ সমর্থনে ও নিজের দৃঢ়তায় এক নতুন আঙ্গিকে তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ সিনেমার মাধ্যমে রুপালি পর্দায় তার আগমন ঘটে।

নব্বই দশকে এসে হুমায়ুন ফরিদী নাম লেখান ‘বানিজ্যিক ধারার বাংলা ছবিতে। ‘হুলিয়া ‘ দিয়ে প্রথম সিনেমাতে অভিনয়। একটি সিনেমায় তার মুখের সংলাপ, ‘আমি শয়তানের উড়োজাহাজ, ঘাঁটি ছাড়াই ল্যান্ড করি।’ এখনও বাংলা সিনেমাপ্রিয় দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে।

নায়ক কিংবা খলনায়ক সব চরিত্রেই সমান পারদর্শিতা দেখানো এই গুণী শিল্পীকে বলা হয় অভিনেতাদের অভিনেতা, একজন আদর্শ শিল্পী। শুধু অভিনয় দিয়েই মানুষকে বিমোহিত করেছিলেন ডাকসাইটে এই অভিনেতা।

হুমায়ুন ফরিদীর রক্তেই যেন মিশে আছে অভিনয়। তিনি অভিনয়ে এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে একসময় নায়কের চেয়ে বাংলা সিনেমা দর্শকদের কাছে ভিলেন বা খলনায়ক ফরিদী বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন। হলে হুমায়ুন ফরিদীর সিনেমা মুক্তি মানেই ওপচে পরা ভীড়। রুপালি পর্দায় ফরিদীর উপস্থিতি মানেই দর্শকদের মুহুর্মুহু হাত-তালি। বানিজ্যিকভাবে সফল ২৫০ টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই ডাকসাইটে অভিনেতা।

বাংলা চলচ্চিত্রের এই জনপ্রিয় অভিনেতার ব্যক্তিজীবন খুব বেশি সুখের ছিল না। আশির দশকের শুরুতে রাজধানীর রমনায় প্রথম স্ত্রী মিনু ওরফে নাজমুন আরা বেগমের সাথে বেলী ফুলের মালা বদল করে বিয়ে করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। ‘দেবযানী’ নামের তাঁর এক মেয়ে রয়েছে এ সংসারে। পরবর্তীতে অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফাকে তিনি বিয়ে করলেও ২০০৮ সালে তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে।

Link copied!