অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ, নাকি চেতনার বিচ্যুতি?

ফারজানা ফাহ্‌মী এবং তৌফিক হোসাইন মবিন

জুন ২৩, ২০২১, ০৭:২৩ এএম

অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ, নাকি চেতনার বিচ্যুতি?
https://www.youtube.com/watch?v=I56z7_8IGt0
 

অসাম্প্রদায়িক এক চেতনা থেকে জন্ম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানী শোষকদের মাঝে থেকেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করা এই দলটি ১৯৫৫ সালের সাধারণ অধিবেশনে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' করে। বর্তমান সময়ের জন্য বিষয়টা যতটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, সে সময় এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেও সহজ ছিল না। কেননা ধর্মের ভিত্তিকে ভাগ হওয়া একটি রাষ্ট্রে ধর্ম নিরপেক্ষ হয়ে রাজনীতি করা ছিল বেশ কঠিন। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার লাভের পরও আওয়ামী লীগকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। 'বিধর্মীদের দল', 'নাস্তিকের দল' এমন অনেক সমালোচনা শোনার পরও আওয়ামী লীগ তার অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে ছিল অটুট। কিন্তু সম্প্রতি হেফাজতের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সেই অসাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।

অনেকেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার অভিযোগও তুলছেন। সম্প্রতি ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত এক কলামে দাবি করা হয়, হেফাজতের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করেছিলো আওয়ামী লীগ। 'বাংলাদেশের জন্ম যেই দলের হাত ধরে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আচরণের অভিযোগ!'- বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন দেশের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি'র (সিপিবি) সভাপতি মুজাহেদুল ইসলাম সেলিম বলেন ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ একসময় সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকলেও বর্তমান সময়ে তারা সাম্প্রদায়িক কার্ডই খেলছে। নির্লজ্জের মত খেলছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারে কাছেও তারা নেই, বিএনপি-আওয়ামী লীগ সবাই এক। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করছে। ধনী শ্রেণীর ধারক বাহক হয়ে উঠেছে আজকের আওয়ামী লীগ।

লেখক ও রাজনৈতিক ইতিহাসবেত্তা মহিউদ্দিন আহমদ শুরুতেই আওয়ামী লীগের অবস্থান পরিষ্কার করে জানান, এখানে অসাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে যে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে তাতে একটা ওয়াদা ছিল যে আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতায় গেলে কুরআন এবং সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশ হবে না। এবং এই একান্ন বছর ধরে এই অবস্থানের কোনো হেরফের হয়নি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যেই সংবিধান হয়, সেখানে রাষ্ট্রীয় চার নীতির মধ্যে একটি ধর্ম নিরপেক্ষতা বলা হয়। এভাবেই কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতা কিংবা অসাম্প্রদায়িকতা শব্দটি বাংলাদেশের সংবিধানে এবং আওয়ামী লীগের লিটারেচারে এসেছে। কিন্তু একই সাথে ওই ওয়াদাটাও থেকেছে যে কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন হবে না। এবং আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ওনারতো বহুমাত্রিক পরিচয়। তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে যেই ভাষণটি দেন সেখানে বলেছিলেন, আমি বাঙালি আমি মুসলমান আমি মানুষ। মুসলমান পরিচয়টাকে কখনোই বাদ দেননি। আবার বাঙালি পরিচয়কেও রেখেছেন। এর মধ্যে আমি কোন কনফ্লিকট দেখি না যদি না রাষ্ট্র অমুসলিমদের উপর কোন ডিসক্রিমিনেট করে।

তিনি আরও বলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ অনেকগুলো ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে নাই, বিশেষ করে উত্তরাধিকার আইন যদি আমরা বলি বা পরিবেশ সংক্রান্ত সিডো সনদের দুইটা ধারা এখনো এনডোর্স করে নাই। আইএলও কনভেনশনের ধারা এন্ডোর্স করে নাই। এছাড়া বেশ কিছু জায়গায় তাদের সিদ্ধান্ত  নিতে গিয়ে পিছু টান রয়েই গেছে। যখনই কোন কোন নির্বাচন হয় বিএনপি চেয়ারপারসন হোক আর আওয়ামী লীগ সভাপতি হোক সিলেটে শাহজালাল এর দরগা থেকেই যাত্রা শুরু করে। এটার একটা সাম্প্রদায়িক মোজেজা আছে। এটা দিয়ে ভোটারদেরকে ইম্প্রেশন দেয়া হয় যে আমরা মুসলমান। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সাথে খেলাফতে মজলিশের একটা চুক্তি হয়েছিলো যে আলেমরা ফতোয়া দিতে পারবে। তাদের ফতোয়া দেয়াটা স্বীকার করে নেয়া হয়েছিলো। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ যেই জিনিসটা চাচ্ছে, তাদের দুইটা উদ্দেশ্য। একটা হচ্ছে তাদের স্ফিয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স এটাকে বিস্তৃত করা, আরেকটা হচ্ছে তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে আইসোলেট করা। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে জাতীয় পার্টি এবং খেলাফতে মজলিশের সাথে একটা জোট করেছিলো। পরে জাতীয় পার্টির সাথে একটা কেমিস্ট্রি কাজ করে। খেলাফতে মজলিশ এখন নাই। তাদের জায়গায় এসেছে এখন হেফাজতে ইসলাম। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা রসায়ন সৃষ্টি হয়েছে। 

আওয়ামী লীগ চাচ্ছে, সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ বা সম্ভাব্য শত্রু যারা আছে তাদেরকে যত বেশি নিজের পক্ষভুক্ত করা যায়, যতটুকু ছাড় দিয়ে সম্ভব। এই লক্ষ বাস্তবায়নেই তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের সাথে জোট করে, আপস করে, যেটা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আওয়ামী লীগের যে নীতি-আদর্শ এবং বঙ্গবন্ধুর দেয়া বাংলাদেশের সংবিধান গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চার মূলনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে আওয়ামীলীগের আজকের যে অবস্থান সেখানে আমি মনে করি নীতিগত অবস্থানের দিক থেকে কোনরকম পার্থক্য নাই। একই নীতি আদর্শ নিয়ে আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলেছে। 

কিন্তু এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পরে তারা এ দেশ পরিচালনা করেছে। তখন তারা সংবিধানকে কলুষিত করেছে, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেছে। এই দীর্ঘ সময়ে সামরিক শাসনের ফলে দেশে যে পরিবর্তন এসেছে তার ভেতর দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে মূলনীতি সেগুলো ধরেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলেছে।

আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা জানতে চাইলে বেশ স্পষ্ট ভাষায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'কেউ যদি বাঁকা চোখে কোন ঘটনাকে দেখতে চায়, দেখতে পারে। মুসলিম নেতাদের সাথে যেমন যোগাযোগ হয়। তেমনিভাবে খ্রিস্টান-বৌদ্ধসহ সব ধর্মের নেতাদের সাথেই যোগাযোগ হয়। মসজিদ বানানোর প্রকল্প গত টার্মের প্রজেক্ট। আর হেফাজতে ইসলামের কিংবা অন্য যে কোন দাবি দাওয়া যাইই মানা হয়েছে অবশ্যই সংবিধান মেনেই তা করা হয়েছে। সংবিধানের বাইরে কোন দাবি দাওয়া মানা হয় নাই।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, যেদিন আওয়ামী লীগ তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে সড়ে আসবে, সেদিনই তার অপমৃত্যু হবে। চেতনা লগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত কখনোই আওয়ামী লীগ তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে এক চুলও নড়েনি, নড়বেও না।

'আওয়ামী লীগ কি তার প্রতিষ্ঠাকালীন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ থেকে সরে এসেছে কি না?' দ্য রিপোর্টের এমন প্রশ্নের উত্তরে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক  বি. এম. মোজাম্মেল হক বলেন, 'আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম। কিন্তু চিন্তা, চেতনা এবং মননে তিনি সকল ধর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। ধর্ম নিয়ে কেউ ব্যবসা করুক প্রধানমন্ত্রী তা চান না। মৌলবাদী, বা উগ্র ধর্মপন্থী দলের যারা রাজনীতি করেন, তাদেরকে যদি তাদের ভ্রান্ত পথ থেকে নিয়ে আসা যায়, সে আশাবাদ থেকেই এ ধরণের দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসে আওয়ামী লীগ। এখন মসজিদের নির্মাণ কাজ চলছে। কিন্তু তাই বলে তো আর আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক না। প্রধানমন্ত্রী মসজিদ নির্মাণের জন্য যেমন অনুদান দিয়েছেন, অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনাগৃহের জন্যও তেমন তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। উগ্র ধর্মাবলম্বীদের রাজনৈতিক দল কিছু আছে। এরা তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। আওয়ামী লীগ চায় তাদেরকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনার জন্য। অত্যাচার করা, নিষ্পেষণ করা তো আওয়ামী লীগের কাজ নয়। তবে সেটা যদি সম্ভব না হয়, তবে আওয়ামী লীগ কঠোর হতেও দ্বিধা করে না।'

এ সময় হেফাজত ইসলামের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, '২০১২ সালের ৫ মে হেফাজত যখন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ তাদেরকে নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। হেফাজত যখন মানতে চায়নি, তখন আওয়ামী লীগ তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেছে। আবার ইদানীং সময়েও, হেফাজতের নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকজন বাড়াবাড়ি শুরু করার পর আওয়ামী লীগ কিন্তু কঠোর হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাস করে, তারা এখনও সে অবস্থানেই অটল রয়েছে। অনেকেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন। আমি নাম বলছি না, তবে বিভিন্ন সময় অনেক বিপ্লবী নেতা বিবৃতিও দিয়েছেন। তবে তারা কেবল বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করেন। সরকার যদি সকলের ভালোর কথা চিন্তা করে শান্তিপূর্ণভাবে এ ধরণের বিষয়গুলোর সমাধান করতে চায়, তখন তারা বলেন আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে সরে এসেছে। আবার আওয়ামী লীগ কঠোর হলে তখন তারাই এসব সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। অনেক বামপন্থী নেতা এখন চরম ডানপন্থী হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তার সেক্যুলার, অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী চেতনা, একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, একটি উন্নত বাংলাদেশ প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।'

আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক নীতি থেকে বিচ্যুত হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে দলটির উপ দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান বলেন, 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনীতির ভিতরে বা বাইরে কোন শক্তির সাথে আদর্শগত দিক থেকে কখনোই আপোষ করেনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেহেতু জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে সেহেতু জনগণের সামষ্টিক স্বার্থ বিবেচনা ব্যতীত আর কোন কিছুতেই সমঝোতা করে না।'

Link copied!