বোতলজাত পানি : আভিজাত্য থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

মার্চ ২২, ২০২১, ১০:৪৮ পিএম

বোতলজাত পানি : আভিজাত্য থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য

দুই যুগ আগে বোতলজাত পানি আভিজাত্যের পণ্য হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু শহরে পানির স্বল্পতা ও বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতার অভাবে এখন বোতলজাত পানি জনসাধারনের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশে বোতলজাত পানির বাজার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ৪০ কোটি লিটার বোতলজাত পানি প্রতিবছরে উৎপাদিত হচ্ছে।

বোতলজাত পানির ভোক্তা বৃদ্ধির কারন

বোতলজাত পানির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরাঞ্চলে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাওয়ার পানির উৎস সীমিত হয়ে পড়েছে। ঢাকা ওয়াসা এবং জারের পানিতে নানা ধরনের দূষণের উপস্থিতি উৎস দুটির ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। এই সুযোগেই ব্যবসা বাড়ছে বোতলজাত পানির।  

উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৩৫-৪০ কোটি লিটার বোতলের পানি বিক্রি হয়। যা টাকার অংকে ৮৫০-৯৫০ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বছরই বোতলের পানির বাজার বাড়ছে প্রায় ২০ শতাংশ হারে।  

ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ওয়াসার পানি ড্রিংকেবল কিন্তু ড্রিংকিং না।যার ফলে পানি খাওয়ার আগে অন্তত ১০ মিনিট ফুটানোর পরামর্শ দেন তিনি।  

জানা গেছে, গত কয়েক বছরে জারের পানির ব্যবসা শহরাঞ্চলে বেশ জমজমাট ছিল। তবে প্রতিনিয়ত নিম্নমান ও ক্ষতিকর বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির প্রমাণ পায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেষ্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে পানির এই উৎসের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।  

বিশুদ্ধ পানির আওতায় কত জনগোষ্ঠী?

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে ইউএনডিপির করা এক জরিপের তথ্য অনুসারে মাত্র ২৭ শতাংশ পরিবার নিরাপদ পানি ব্যবহার করছে। যাদের ৭৫ শতাংশই টিউবওয়েল ব্যবহার করছে। এদিকে ৫১ শতাংশ লোক বছরের অর্ধেক সময়ে পানির সমস্যার মধ্যে থাকে। আর মাত্র ১৬ শতাংশ লোক নিজস্ব নিরাপদ পানির উৎস ব্যবহার করছে।  

পানি বাজারজাতকরনের পরিস্থিতি 

পারটেক্স যখন দেশে ‘মাম’ পানির উৎপাদন শুরু করে তখন এটাকে অনেকেই অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছিলেন। সে সময় বোতলের পানির ব্যবহার ছিল আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। পাঁচ তারকা হোটেল ও বিভিন্ন দামী রেস্তোরাগুলোতেই বোতলজাত পানি ব্যবহৃত হত। বছরখানেক আগে জারের পানি জনপ্রিয় থাকলেও দূষিত পানি ও জীবাণু পাওয়ায় ভোক্তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি বদলে বোতলজাত পানি এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে ঢাকার ছোটখাট দোকান ও রেষ্টুরেন্টগুলোতে জারের পানির ব্যাপক প্রচলন দেখা গেলেও এখন খানিকটা কমে গেছে। কারণ এই পানির মান নিয়ে অনেক সন্দেহ তৈরি হয়েছে ভোক্তাদের মধ্যে। যার ফলে সহজেই বহনযোগ্য বোতলজাত পানি এখন পছন্দের শীর্ষে।

বোতলজাত পানির ভবিষ্যৎ

বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশকে বোতলজাত পানির ব্যবসার জন্য ভালো বাজার হিসেবে দেখছে। এর প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে পেপসিকো (অ্যাকুয়াফিনা) ও ২০১৬ সালে কোকাকোলার (কিনলে) মত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বাংলাদেশে পানির ব্যবসায় আসে। এছাড়া মেঘনার ফ্রেশ, প্রাণ-আরএফএলের প্রাণ, ঢাকা ওয়াসার শান্তি, সিটি গ্রুপের জীবন, একমি গ্রুপের একমি ড্রিংকিং ওয়াটারসহ দেশে ৩০ টিরও বেশি পানির ব্র্যান্ড রয়েছে।   

বোতলের পানির ব্যবসা বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে প্রাণ আরএফএলের বিপনন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, 'শহরাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির অপ্রাপ্যতাই বোতলের পানির ব্যবসাকে বড় করছে। এছাড়া পানির অন্য যেসব উৎস রয়েছে সেগুলোতে মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না।'  

শুধু দেশেই না, বিশ্বব্যাপীই দ্রুত বাড়ছে পানির ব্যবসা। এশিয়া, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান দ্য বিজনেস রিসার্চ কোম্পানির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ২০১৭ সালে পানির ব্যবসার পরিমাণ ছিল ২৩৮ বিলিয়ন ডলার এবং পানি বিক্রি হয়েছে ৪৩৭ বিলিয়ন লিটার। গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে ২০২১ সালে বোতলজাত পানি বিক্রি হবে ৬২৩ বিলিয়ন লিটার যার মূল্য ৩৪৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে প্রায় ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী যেসব কোম্পানি পানির ব্যবসা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে নেসলে, পেপসিকো, দ্য কোকাকোলা কোম্পানি, ড্যানোন, প্রিমো ওয়াটার কর্পোরেশন, ভস ওয়াটার, নংফু স্প্রিং ইত্যাদি।  

Link copied!