‘বয়স হয়্যা গেছে গো মা, অহন আর শরীর আগের মতো চলে না। একবার সর্দি লাগলে আর সারবার চায় না। এই বৃষ্টিতে আজকের সারাদিনের কামাই বরবাদ কইরা দিল। দিন আইনে দিন খাওয়ার সংসার আমার। কাম না করলি তো সংসার চালাবার পারমু না। সকাল থেকে কোন খেপ পাচ্ছি নে। আইজকা মনে অয় আর কপালে খাওন জুটবো না।’
রবিবার রাজধানীর রামপুরা ব্রিজের উপর বিকেলে খেপের আশায় ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলেন রিকসাচালক বারেক মিয়া (৫৫)। কথাগুলো বলে আক্ষেপ ছাড়লেন তিনি। প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল। এ সময় সাধারনত বৃষ্টি হয় না। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে হঠাৎ সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদের’প্রভাবে ঢাকাসহ সারাদেশে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে জনজীবনও কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে। পথে লোকজন চলাচলও কম। যে কারণে জড়োসড়ো হয়ে নিজের রিকশার উপরই হাতপা গুটিয়ে বসেছিলেন বারেক মিয়া।
আজকের সারাদিনের আয়-রোজগার কেমন হল? এমন প্রশ্নে বারেক মিয়া জানালেন, অন্য সময় বৃষ্টি হলে রিকশা চালাতে সমস্যা হয় না। তবে আজকে একে তো সারাদিন বৃষ্টি, অন্যদিকে ঠাণ্ডায় তার শরীরও চলছে না । কাজ না করলে আয় রোজগারও নাই। চালডাল কিনে নিজের বস্তিতে ফিরতে পারবেন কিনা তিনি জানেন না।
রবিবার রাজধানীতে সকাল থেকেই শুরু হয় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। জনজীবনেও এর প্রভাব পড়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন রাস্তায় কর্মরত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। বিশেষ করে রিকশাওয়ালা, ফুটপাতের দোকানদার, শীতের পিঠা বিক্রেতা এবং রাস্তায় বসবাস করা ছিন্নমূল মানুষগুলো।
হাতির ঝিল ব্রিজের উপরে কথা হয় ছিন্নমূল শিশু রাসেলের সাথে। সে জানালো, এক কাপড়েই সে থাকে, এক কাপড়েই ঘুমায়। শীত লাগলেও এই একটি জামাই তার সম্বল। রাসেলের ভাষ্য, ‘এই বৃষ্টি আইয়্যা শীত আরো বাড়ায়্যা দিয়া গেলো।’
রাসেল বলতে থাকে, আমাগো সর্দি লাগলেই কি? জ্বর আইলেই কি? আমাগো তো মা-বাপ নাই। যেই হানে রাইত হয়, সেই হানেই আমরা ঘুমাই। তয় অহন অনেক ঠাণ্ডা লাগতাছে।
কথা হয় কাওরান বাজারের চায়ের দোকানদার লাবনীর সাথে। লাবনীর দোকানে ধুমছে চা-সিগারেট বিক্রি হয়। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টির কারণে তার বিক্রিবাট্টা খুবই কম। তার ভাষায়, আইজ বেচাকিনা নাইগো আফা!
অফিস যাওয়ার পথে অনেকেই মাঝরাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টিতে পড়েছেন। কেউ যানবহানে উঠতে পেরেছেন। কেউবা আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন দোকানে, অফিস রুমের বারান্দা বা আবাসিক বাড়ির বারান্দায়।
অফিসগামী আফজাল হোসেন যেমনটা বাংলামোটর এসে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছেন। যাবেন মতিঝিল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি গণপরিবহন পাননি। এই সুযোগে বাড়তি ভাড়া হাকাচ্ছেন রিক্সাচালক, পাঠাও কিংবা উবার চালকেরা। অভিযোগের সুরে আফজাল বললেন, অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বাস পাচ্ছি না। রিক্সাও অনেক ভাড়া চাচ্ছে। উবার-পাঠাও নেই। এমনিতেই আনওয়ান্টেড বৃষ্টি। তার উপর আকাশচুম্বি ভাড়া!
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা রাশেদ। বৃষ্টির কারণে ভ্যানের উপর থাকা সবজিগুলো পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, আজকে এই সবজি বেচা তেমন অইব না। বৃষ্টির কারণে সবজিগুলো পঁইচাও যাইতে পারে! কি করুম বুইঝা পাইতাছি না। আইজ লস হয়্যা যাবো।
আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, আজ রবিবার এবং কাল সোমবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বাড়তে পারে শীতের প্রকোপ। ভয় কেটে গেলেও বাড়তি সতর্কতার জন্য বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে এখনো ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বজায় রাখতে বলা হয়েছে। আর নদীবন্দরগুলোতে ১ নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল শনিবার বৃষ্টি না হলেও সূর্যের তাপ ছিল কম। রবিবার সকাল থেকেই ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ জায়গায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির খবরও পাওয়া গেছে।
নিম্নচাপের প্রভাবে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর বিভাগে অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ আরও উত্তর দিকে অগ্রসর এবং দুর্বল হয়ে একই এলাকায় গভীর নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করছে। এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এক হাজার ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। এখন আরও কাছে এসে ৯৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে পারে।