বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব রেখেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড। তবে অস্ত্র বিক্রিসংক্রান্ত জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া) ও আকসা (অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট) চুক্তিতে সই করলে বাংলাদেশের ক্ষতির সম্ভাবনা দেখছেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল। তাদের মতে, বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর পর নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন দেশে অস্ত্র বিক্রি করার জন্য দেনদরবার শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।ইউক্রেনের প্রতিবেশি দেশ পোল্যান্ড, রোমানিয়া, লাটভিয়া, চেক প্রজাতন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রকে ড্রোন, মিসাইলসহ বিভিন্ন অস্ত্র কেনার ব্যাপারে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
এরই ধারাবাহিকতায় এশিয়ার দেশগুলোতেও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা জোরদারে তৎপর শুরু করে ওয়াশিংটন। তাদের প্রধান টার্গেট দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অষ্টম অংশীদারত্ব সংলাপের জন্য আন্ডার সেক্রেটারির নেতেৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসলেও মূলত তাদের টার্গেট ছিল ওয়াশিংটনের অস্ত্র বিক্রিসংক্রান্ত জিরোসিমা চুক্তিতে সইয়ের ব্যাপারে ঢাকার পক্ষ থেকে নিশ্চিত হওয়া।
একারণেই ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড সংলাপে বলেন, ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশকে নিয়ে পথ চলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইন এখন হুমকির মুখে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ যুক্তরাষ্ট্র তার সব অংশীদারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
বাংলাদেশের নিরাপত্তায় মার্কিন অস্ত্র কেনাসংক্রান্ত জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া) এর খসড়া হস্তান্তর করে নুল্যান্ড বলেন, “আমি আশা করি এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবে বাংলাদেশ।”
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে এই চুক্তি করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবসংক্রান্ত এ চুক্তিকে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মোটেও ভাল চোখে দেখছেন না।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান এ বিষয়ে বলেন, “ নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে মার্কিন প্রশাসন আকসা ও জিসোমিয়া নামে দু’টি চুক্তির খসড়া দিয়েছেন। এই চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছে। বাংলদেশ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক এলাকা। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির কথা বলে এই অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারলে ভবিষ্যতে তা বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই আমি মনে করি এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
একই মত প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড, দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, “ ইউক্রেনের যুদ্ধ ইস্যু তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এশিয়ার দেশগুলোতে অস্ত্রের ব্যবসা প্রসার করতে চায়। তবে বাংলাদেশ সব সময় সামরিক জোটের বিরোধী অবস্থানে থাকায় এবং এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তিতে না থাকায় তারা লাভবান হতে পারছে না।“
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “নুল্যান্ডের আগে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী র্যান্ডল শ্রাইভার দুইদিনের সফরে ঢাকা এসেছিলেন। ওইসময় তিনিও দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সাথে কথা বলেন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই চুক্তির বিষয়ে সাড়া দেয়নি।”
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সাবেক সহকারী মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী র্যান্ডল শ্রাইভার। ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, “র্যান্ডল শ্রাইভারের সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ উন্নত প্রযুক্তির হেলিকপ্টার ও রাডার কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী কোনো দেশের কাছে উন্নত প্রযুক্তির সমরাস্ত্র বিক্রির আগে সেই দেশের সঙ্গে জিসোমিয়া সই করার বাধ্যবাধকতা থাকায় বাংলাদেশ তখন ওই চুক্তি থেকে সরে আসে।”
দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্রের যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও জড়িত। জিসোমিয়া চুক্তি সই হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজণীতিসহ সামরিক ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নাক গলাতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জিসোমিয়া ও আকসা চুক্তি বাংলাদেশের জন্য আশান্তির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের(ঢাবি) শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, “সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। ফলে যেখানে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা প্রবেশ করেছে সেখানেই মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। জনগণের ঐক্যে বিভক্তি ধরিয়ে তার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ-চরিতার্থ করেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “জিসোমিয়া ও আকসা (আকসার অধীনে মার্কিন বাহিনী খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি বিনিময় হয়ে থাকে) চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যেকোনো উপায়ে প্রবেশ করতে চাইছে, যা ভবিষ্যতে সামরিক হস্তক্ষেপ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তাই এমন কিছু ঘটার আগেই সরকারকে খুব সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, “সফররত মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি নুল্যান্ড ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের উন্নয়নে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বিষয়কে ‘জটিল ও কঠিন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেও তাদের কোনো জোরদার ভূমিকা দেখা যায় না। অথচ সহযোগিতার কথা বলে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছেন। এতেই বোঝা যায় তাদের আসল মতলব।”
২০১৯ সালের জুনে ওয়াশিংটনে তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ও রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ডেভিড হেইলের মধ্যে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্ব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সংলাপেও জিসোমিয়া সইয়ের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। এবারের সংলাপেও জিসোমিয়া ও আকসার (অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট) বিষয়টি প্রাধান্য পায়। তাই কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া চুক্তির খসড়া চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সরকারকে সতর্কতার সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।