ছবি: সংগৃহীত
জেনে হয়তো কিছুটা স্বস্তিই পাবেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে সঠিক উপায়ে কাজে লাগানো যায়—এ নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীই হিমশিম খাচ্ছে। ভবিষ্যতে এআই আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, সেই অনিশ্চয়তার রোমাঞ্চ নাহয় থাক। তবে যেটুকু জ্ঞান আমাদের হাতে আছে, তার ভিত্তিতে তৈরি হওয়ার চেষ্টা তো আমরা করতেই পারি।
তথ্যের গুদাম নয়, চিন্তার কারখানা
এআই এখন আস্ত কোর্স ডিজাইন করতে পারে, প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারে, এমনকি প্রশ্নপত্র তৈরিও করতে পারে। তাহলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে? না, বরং এর ভূমিকা বদলে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল থিংকিং ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা তৈরি করাই এখন বড় কাজ।
চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে একজন শিক্ষার্থী একটা প্রবন্ধ লিখতেই পারে। কিন্তু সেই প্রবন্ধের যুক্তিগুলো কি ঠিক? তথ্য কি নির্ভরযোগ্য? এর চেয়েও ভালো কি লেখা সম্ভব?—এই প্রশ্নগুলো করার এবং উত্তর খোঁজার সক্ষমতাই একজন শিক্ষার্থীকে আলাদা করবে।
আগে স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা আমাদের নীতি-নৈতিকতা শেখাতেন। এখন তাঁদের দায়িত্ব আরও বাড়বে। ডিজিটাল লিটারেসি থেকে শুরু করে এআই এথিকস—অর্থাৎ প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহারের চর্চাও ক্লাসরুমে করতে হবে। ‘আমি সব জানি এবং আমিই সব শেখাব’—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে ‘চলো আমরা একসঙ্গে শিখি ও সমস্যার সমাধান খুঁজি’—শিক্ষকদের এই মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পড়াশোনাই হয় না; দলবদ্ধ কাজ, বিতর্ক এবং মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ তৈরি করে। এই মানবিক যোগাযোগের দক্ষতা (সফট স্কিল) এআই কখনো দিতে পারবে না। চাকরির বাজারে এই দক্ষতাগুলোই হয়ে উঠবে সবচেয়ে মূল্যবান।
কারিগরি বিষয়ে পড়ালেখা যাদের
এআই কোড লিখতে পারলেও প্রোগ্রামার বা প্রকৌশলীদের প্রয়োজন ফুরাবে না। বরং তাঁদের কাজের ধরন পাল্টে যাবে। সাধারণ কোড লেখার কাজ হয়তো এআই করবে, কিন্তু একটি সফটওয়্যার বা সিস্টেমের মূল নকশা (আর্কিটেকচার) তৈরি, জটিল সমস্যা চিহ্নিত করা এবং পুরো প্রকল্পের পরিকল্পনার কাজটা মানুষকেই করতে হবে। কোডারের ভূমিকা হবে একজন ‘সিস্টেম আর্কিটেক্ট’ বা ‘প্রবলেম সলভার’-এর মতো।
এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো—শুধু প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে বসে থাকলে হবে না। সিস্টেম ডিজাইন, অ্যালগরিদম অপটিমাইজেশন, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং এআই মডেলকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মোদ্দাকথা ‘কীভাবে কোড লিখতে হয়’ শুধু নয়, বরং ‘কোন সমস্যা সমাধানের জন্য কী ধরনের কোড বা টুল ব্যবহার করতে হয়’—সেটা শেখা বেশি জরুরি।
বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের বাইরে যাদের পড়ালেখা
এআই উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পারে, প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে পারে, এমনকি কবিতা বা প্রবন্ধও লিখতে পারে। কিন্তু এটি যা পারে না, তা হলো মানুষকে বোঝা। অতএব যারা সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবসা প্রশাসন বা অর্থনীতি নিয়ে পড়বেন, তাদের জন্যও আছে বহু সুযোগ। শুধু পুরোনো ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
একটি এলাকায় কত শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, এআই হয়তো চট করে সেটা বলে দিতে পারবে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র বলতে পারবেন, সেই দারিদ্র্যের পেছনের সামাজিক কারণগুলো কী, এর ফলে পারিবারিক সম্পর্কে কী প্রভাব পড়ছে এবং এর থেকে উত্তরণের জন্য কোন ধরনের মানবিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। এই সহানুভূতি এবং পটভূমি বোঝার সক্ষমতা এআইয়ের নেই।
বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থী জানেন, কীভাবে শব্দ ব্যবহার করে মানুষের মনে আবেগ তৈরি করতে হয়। ‘যোগাযোগ’ নিয়ে পড়া একজন শিক্ষার্থী জানেন, কীভাবে একটি বার্তা দিয়ে মানুষকে কোনো ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হয়। এই গল্প বলার ক্ষমতা বিপণন ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। এসবের ওপর দখলও আদতে মানুষেরই থাকবে।
সোজা কথায়, প্রযুক্তি যদি হয় শক্তিশালী একটি ইঞ্জিন, তবে ব্যবসা-কলা-মানবিকের বিষয়গুলো হলো তার স্টিয়ারিং হুইল, যা নির্ধারণ করে ইঞ্জিনটি কোন পথে চলবে।
এআই-দুনিয়ায় প্রয়োজনীয় ১০ সাধারণ দক্ষতা
১. বিশ্লেষণের সক্ষমতা: যেকোনো তথ্যকে প্রশ্ন করা। সত্যতা ও গভীরতা যাচাই করা।
২. সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন: নতুন ধারণা তৈরি। গতানুগতিক ধারার বাইরে চিন্তা করা।
৩. আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা: নিজের ও অন্যের আবেগ বোঝা। আবেগ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা।
৪. নৈতিকতার ধারণা: ঠিক ও ভুলের পার্থক্য বোঝা। প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার।
৫. যোগাযোগ ও গল্প বলা: সহজ উপস্থাপনা। মানুষের মনে প্রভাব ফেলার মতো কথা বলা বা লেখা।
৬. ডিজিটাল ও এআই সাক্ষরতা: আধুনিক প্রযুক্তি ও বিভিন্ন এআই টুল দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারা।
৭. আন্তসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া: বিশ্বায়নের যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
৮. নেতৃত্ব ও সহযোগিতা: দলের সঙ্গে কাজ করা। নেতৃত্ব দিতে পারা।
৯. আলোচনা ও মীমাংসা: নিজের যুক্তি দিয়ে অন্যকে প্রভাবিত করা এবং সমঝোতায় পৌঁছানোর দক্ষতা।
১০. অভিযোজন ক্ষমতা: দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা।
এআই-দুনিয়ায় প্রয়োজনীয় ১০ কারিগরি দক্ষতা
১. জটিল সমস্যা সমাধান: জটিল প্রযুক্তিগত সমস্যার মূল কারণ খুঁজে সমাধানের নকশা করা।
২. সিস্টেম থিংকিং: একটি সিস্টেমের বিভিন্ন অংশ কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার সক্ষমতা।
৩. এআই ও মেশিন লার্নিং: এআই মডেলগুলো বোঝা, এআইকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো।
৪. উপাত্ত বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ: বিপুল পরিমাণ উপাত্ত (ডেটা) বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
৫. সাইবার নিরাপত্তা: ডিজিটাল সিস্টেমকে সুরক্ষিত রাখার জ্ঞান ও দক্ষতা।
৬. প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং: এআইকে ঠিকঠাক নির্দেশনা দেওয়া, যেন সেরা ফলটা পাওয়া যায়।
৭. প্রকল্প ব্যবস্থাপনা: একটি পণ্য বা সেবা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালনার দক্ষতা।
৮. মানুষ ও কম্পিউটারের মিথস্ক্রিয়া: সবার জন্য সহজ ও কার্যকর প্রযুক্তি ডিজাইন করা।
৯. ক্লাউড কম্পিউটিং: অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস, মাইক্রোসফট অ্যাজিওর বা গুগল ক্লাউডের মতো প্ল্যাটফর্মে কাজের দক্ষতা।
১০. সফটওয়্যার আর্কিটেকচার: বড় ও জটিল সফটওয়্যার সিস্টেমের ভিত্তি বা কাঠামো ডিজাইন করা।
সূত্র: প্রথম আলো।