ডিসেম্বর ১৫, ২০২২, ১২:০৭ এএম
আজ ১৫ই ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এদিনের মধ্যেই যুদ্ধের ভাগ্য মোটামুটিভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থিত ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
তবে পাকবাহিনীর কমিশন থেকে আত্মসমর্পণের প্রকৃত নির্দেশ ছিল না। এদিন, জেনারেল এএইচ খান নিয়াজিকে একটি বার্তা পাঠান পাকিস্তানের সেনাপ্রধান। ওই বার্তায় তিনি বলেন, "আমি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো আপনার বার্তাটি দেখেছি। আপনি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীন কিন্তু আমার পরামর্শ হবে ভারতীয় বাহিনীর দেওয়া শর্তাবলী মেনে নেওয়া।”
১৯৭১ সালের এদিন নিয়াজীর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিবেচনা করে মিত্রবাহিনী ভোর ৫টা থেকে ঢাকায় বিমান হামলা বন্ধের ঘোষণা দেয়। এছাড়া মিত্র বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বলে, ‘ সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের আগে কোনো যুদ্ধবিরতি ঘটবে না। যদি ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টার মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে আবার বিমান হামলা শুরু হবে।’
এদিন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেওয়ারে খবর পেয়ে মার্কিন ৭ম নৌবহর দিক পরিবর্তন করে।
একাত্তরের এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পোল্যান্ডের দেওয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। এর আগে পোল্যান্ড বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করে পাকিস্তানি বাহিনীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা বলে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন ভুট্টো।
ভুট্টো এ প্রস্তাবের জবাবে বলেন, 'আমি সারেন্ডার ডকুমেন্ট নিয়ে ফিরতে চাই না। আমি একটি আগ্রাসন সমর্থনের ডকুমেন্টকে বৈধতা দিতে পারি না। নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ৪ দিন ধরে আমরা এখানে কথা বলছি। আর তারা কেবল ঢাকায় আত্মসমর্পণের প্রস্তাব তুলছে। কিন্তু কেন? কারণ তাদের লক্ষ্য ঢাকার পতন হওয়া।”
ভুট্টো তার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে এসে প্রস্তাবের কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, 'আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করছি? আমি যাচ্ছি। জাতিসংঘে এটাই আমার শেষ আসা।'
একাত্তরের এদিন, পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন। বগুড়ায় পাকিস্তানি ডিভিশন এবং ব্রিগেড সদর দপ্তর বিকেলের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল এবং ১,৭০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়।
১৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কাছে সাভার হারিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গাবতলীর কাছে অবস্থান নেয়। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। এ সময় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।
১৯৭১ সালের এদিন গাজীপুর হানাদারমুক্ত হয়। এর আগে ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর গাজীপুর সেনানিবাসে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালালে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী চান্দলা চৌরাস্তায় অবস্থান নেয়। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী গাজীপুরের ছয়দানা ও টঙ্গীতে অবস্থান নিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে কাশিমপুর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীও আর্টিলারি হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর বহু সেনা নিহত হয়। একইসঙ্গে হানাদার বাহিনীর প্রচুর সমরাস্ত্র ধ্বংস হয়।
১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি হানাদারমুক্ত হয়। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের এসডিও বাংলোতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিবাহিনী।
একাত্তরের এদিন মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কাছে কুমিল্লা ময়নামতি সড়কে অবস্থানরত ১৫০ হানাদার সেনা আত্মসমর্পণ করে।
১৯৭১ সালের এদিন বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ১ হাজার ৭০০ সেনা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাহিনী।
১৫ ডিসেম্বর ফরিদপুরের মধুখালির কামারখালীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির ওপর ব্যাপক আক্রমণ পরে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বই-পুস্তক ও গবেষণা থেকে সংগৃহীত ঘটনাবলী নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের দর্শক ও পাঠকদের জন্য প্রতিবেদন সিরিজ ‘বিজয়ের দিনলিপি’ তৈরি করা হয়েছে। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের ইউটিউব চ্যানেলেও প্রতিবেদনটি ভিজুয়ালি দেখা যাবে।