আগস্ট ১৮, ২০২৫, ০৬:৫২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ঋণের বোঝা আর সুদের চাপ সহ্য করতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে শহরে রিকশা চালাতেন ফজলুর রহমান (৫৫)। ইচ্ছা থাকলেও আর বাড়িতে ফেরা হয়নি। তবে অবশেষে তিনি লাশ হয়ে ফিরেছেন নিজ গ্রামে। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এর আগে তার মুখে ঢালা হয়েছিল ঘাস মারার বিষ। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন (গত শুক্রবার) মারা যান তিনি। এক ভিডিওতে তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম বলে গেছেন। এ ঘটনায় করা মামলায় ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ফজলুর রহমান রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের বেলনা গ্রামের বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) রাত আটটার দিকে বাড়ির পাশে পা বাঁধা, গলায় রশি বাঁধা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, তার মুখে একপ্রকার ঘাস মারার বিষ ঢেলে ফেলে রাখা হয়েছিল। এর পেছনে ধুলু মিয়া নামের এক সুদের কারবারি জড়িত। ধুলু মিয়াকে অভিযুক্ত করে শনিবার রাতে মোহনপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন ফজলুরের স্ত্রী আনজুয়ারা বিবি। ওই রাতেই ধুলুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার ধুলু মিয়া (৪৫) মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট পৌরসভার বাসিন্দা। ফজলুরের স্ত্রী আনজুয়ারা বিবির করা হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
মামলার এজাহারে আনজুয়ারা উল্লেখ করেন, তার স্বামী ফজলুর শহরে রিকশা চালান। তিনি সেখানেই থাকতেন। মাঝেমধ্যে বেলনা গ্রামে আসতেন। রাজশাহী শহর থেকে ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টার দিকে কেশরহাটে যান। সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি বেলনার উদ্দেশে রওনা দেন। পরে রাত ১১টার দিকে তাদের বাড়িসংলগ্ন একটি চায়ের দোকানের সামনে ফজলুরকে হাত–পা বেঁধে ফেলে রেখে যায়। একপর্যায়ে প্রতিবেশীরা সেখানে জড়ো হয়ে দেখতে পান, ফজলুরের মুখ থেকে অনবরত লালা পড়ছে এবং মুখ দিয়ে বিষের গন্ধ বের হচ্ছে। তখন তাকে মোহনপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় ফজলুর তার বড় ছেলে শাহ আলমকে (২৫) জানান, ধুলুসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৫–৬ জন মিলে হাত–পা বেঁধে তাকে বিষ খাইয়েছেন। পরে শুক্রবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফজলুরের মৃত্যু হয়।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় বেলনা গ্রামে ফজলুর রহমানের বাড়িতে যান এই প্রতিবেদক। তার বাড়িতে পৌঁছাতেই আশপাশের লোকজন জড়ো হন। সবাই বলাবলি করছিলেন যে পরিবারটির এখন কী হবে। ওই সময় বাড়িতে ফজলুর রহমানের স্ত্রী ও ছোট ছেলে তারেক ছিলেন।
ফজলুরের চাচাতো ভাই এনামুল হক অভিযোগ করেন, ধুলু সুদের কারবার করেন। গ্রামের আরও লোকজনকে টাকা ধার দিয়েছেন। ২০২২ সালে ধুলুর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নেন ফজলুর। সেই টাকার সুদ বাবদ ৪৩ হাজার টাকা পরিশোধ করেন তিনি। কিন্তু আরও ৩০ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন ধুলু। এ টাকা তিনি দিতে পারেননি। এ নিয়ে সালিসও হয়েছে। সালিসে ১৫ হাজার টাকায় মীমাংসা করা হয়েছিল। কিন্তু ধুলু মানেননি। এ নিয়ে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন।
আনজুয়ারা বিবি বলেন, ‘গত কোরবানি ঈদের তিন থিকে চাইর দিন আগে ধুলু আইছিল। আমার স্বামী বলিনু, আমার তো পরিস্থিতি খারাপ। আমি পাঁচ হাজার টেকা দিনু। এটা নিয়া আমারে মাফ কইরা দেন। পরে টেকা না নিয়া বলে, “তোর যদি ব্যবস্থা না করতে পারি...” আরও পরে কী কী বলছিল, জানি না। তারপর সেদিনকাই (ফজলুর) রাজশাহী শহরে চলে যায়। আর এখানে আসেনি। তার পর থিকে আমি ছিনু এখানে। আমরাই মাঝেমধ্যে যাই। আর বাড়ি আসিনি স্বামী। লাশ হয়ে ফিরিচ্ছে।’
কথা বলার এ পর্যায়ে কান্না চেপে রাখতে পারেননি আনজুয়ারা। তিনি কান্না করতে করতে বলেন, ‘কাইল থাইক্যে পাড়া-প্রতিবেশীরা চাইল দিছে। আমার ঝাইয়েরা দিছে। আমার ঘরেত একমুঠোত নাই যে হাড়ি দিব। একবারে নিঃস্ব। আমার স্বামীকে যারা মাইরেছে, আমি চাই, তারাও যেন না বাঁইচতে পারে।’
ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কাওসার সরদার জানান, ‘ধুলুর কাছে আলু চাষের জন্য কিছু টাকা নিয়েছিলেন ফজলুর। পরে বিষয়টি নিয়ে গ্রামবাসী বসেছিল। সেখানে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। শুনেছি, মারা যাওয়ার আগে একটি ভিডিওতে ফজলুর একজনের নাম বলেছেন। তিনি ঋণে জর্জরিত ছিলেন। অনেক এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এ কারণে বাড়িতেই থাকতেন না। শহরে গিয়ে রিকশা চালাতেন।’
মামলা ও ধুলুকে গ্রেপ্তারের সত্যতা নিশ্চিত করে মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান বলেন, মারা যাওয়ার আগে ফজলুর রহমান অভিযুক্ত একজনের নাম ভিডিওতে বলে গেছেন। তাকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। খবর প্রথম আলো।