আগস্ট ১৩, ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বছর দেড়েক আগে ফিলিস্তিনের অধিকৃত গাজা উপত্যকার প্রায় ২০০ ছাত্রীকে বৃত্তি দিয়েছিল চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়টির তালিকায় থাকা ছাত্রীদের মধ্যে ১৮৯ জনকে গত বছরের অক্টোবরে ভিসা অন অ্যারাইভালের (আগমনী ভিসা) অনুমতি দেয়।
গাজা থেকে জর্ডান হয়ে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের চট্টগ্রামে পৌঁছানোর কথা ছিল এ বছরের মাঝামাঝি। কিন্তু হঠাৎ করেই গত জুনে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন কর্তৃপক্ষকে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের আগমনী ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের কথা জানায়। এ কারণে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের বৃত্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের পড়াশোনা ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। খবর প্রথম আলো।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের পৌঁছানোর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার পর বৃত্তি পাওয়া অন্তত ৩০ ছাত্রীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলের হামলায় ওই ছাত্রীরা নিহত হয়েছেন, কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছেন। এ পরিস্থিতিতে নিখোঁজ ৩০ ছাত্রীর পরিবর্তে বৃত্তির জন্য বাছাই হওয়া তালিকা থেকে নতুন ছাত্রীদের নাম যুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৭১ জন ফিলিস্তিনি ছাত্রীর জন্য ভিসার আবেদন জানিয়েছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন কর্তৃপক্ষ। সূত্র বলছে, অন্তত ১৩০ ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হতে আসার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন চট্টগ্রামে অবস্থিত। এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের পড়াশোনার পথ সুগমের জন্য সহায়তা করে আসছিল। কিন্তু গত জুনে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানায়, আগমনী ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো লিখিত নির্দেশনা আছে কি না, তা এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনকে জানানো হয়নি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার গত বছর অক্টোবরে ফিলিস্তিনের মেধাবী ছাত্রীদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার পর থেকেই একটি মহল তাতে বাধার সৃষ্টি করে। ওই মহল সরকারের নানা পর্যায়ে যোগাযোগ করে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের বক্তব্য হলো, ফিলিস্তিনের ছাত্রীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতে পারেন। এই যুক্তি তুলে ধরে মহলটি প্রকারান্তরে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে আসা বন্ধের জন্য সরকারি স্তরে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানায়। ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পড়তে আসা বন্ধের নেপথ্যে ঢাকায় ফিলিস্তিনের দূতাবাস রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে কূটনৈতিক একাধিক সূত্র।
সহায়তায় সংযুক্ত আরব আমিরাত
ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে বৃত্তি দেওয়ার বিষয়টি ঘোষণার পর থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ছাত্রীদের নিয়ে আসার প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের কাছেও বিষয়টি সুরাহার অনুরোধ জানিয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে দূতাবাস জানায়, ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসের বিশেষ ফ্লাইটে বাংলাদেশে আনা হবে। তাদের গাজা থেকে জর্ডানের কুইন আলিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছানো হবে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের বাহনে। আর সড়কপথে ছাত্রীদের আনার বিষয়টি সমন্বয় করবে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাই ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের সড়কপথে গাজা থেকে জর্ডানে নিয়ে আসার বিষয়ে আম্মানের বাংলাদেশ দূতাবাস যেন দেশটির (সংযুক্ত আরব আমিরাত) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমতি সংগ্রহ করে।
অনুমতি দেওয়ার পর কোনো কারণ না দেখিয়ে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের আগমনী ভিসা সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অবাক করেছে বলে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে।
প্রস্তুতি আর বাধা—দুটোই চলছে
সরকারের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের আগমনী ভিসা বাতিল করা হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের বাংলাদেশে আনার প্রস্তুতি অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সুরাহার জন্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তবে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়াশোনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী মহলটিও বসে থাকেনি। তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নানা পর্যায়ে চাপ অব্যাহত রেখেছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের পড়াশোনা নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির বিষয়ে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় ফিলিস্তিন দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে। এ সময় দূতাবাস লিখিতভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, গাজার মেধাবী ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ফিলিস্তিনি ছাত্রীরা এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পড়ুক, এটা দূতাবাস চায় না। দূতাবাস মনে করে, ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকায় ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রামাদান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ফিলিস্তিন দূতাবাস বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য, বিশেষত গাজার শিক্ষার্থীদের জন্য, প্রদত্ত সব ধরনের বৃত্তিকে স্বাগত জানায়। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা দুই শর বেশি বৃত্তি পেয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায় তারা গাজা থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইউসুফ রামাদান বলেন, ‘ফিলিস্তিন সরকারের নীতি অনুযায়ী, শুধু ফিলিস্তিনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৃত্তিই গ্রহণ করা হয়। ফলে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এই স্বীকৃতি পায়নি, সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোর অনুমতি আমরা দিতে পারি না। বাংলাদেশে অবস্থিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দূতাবাস ফিলিস্তিন সরকারের নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।’
এদিকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল আহমেদ চলতি মাসের শুরুতে ফিলিস্তিন সফর করেন। এ সময় তিনি ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র ও প্রবাসীবিষয়ক মন্ত্রী ভারসেন আঘাবেকিয়ান শাহিন এবং শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষামন্ত্রী আমজাদ বারহামের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় ফিলিস্তিনের দুই মন্ত্রী গাজার ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করায় তাকে ধন্যবাদ জানান বলে উল্লেখ করেন কামাল আহমেদ।
কামাল আহমেদ গত বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিন থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ৬০০ জনের বেশি আফগান শিক্ষার্থীর আগমনী ভিসার ব্যবস্থা করেছিল। তখন বাংলাদেশ সরকার আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের অনুমতির অপেক্ষা করেনি। সিরিয়া, ইয়েমেনসহ অন্য দেশ থেকেও ছাত্রীরা পড়তে এসেছেন। তাদের ভিসা দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সরকারের অনুমতি নিতে বলা হয়নি। ফিলিস্তিনের বেলায় এমন ব্যতিক্রম কেন?
কামাল আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে অবিলম্বে ফিলিস্তিনি ছাত্রীদের ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই।’
‘এখনো কি আশা আছে?’
এদিকে ভর্তির জন্য অপেক্ষমাণ ফিলিস্তিনি ছাত্রী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা দু-তিন মাস ধরে ই-মেইল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর ইসরায়েলের নৃশংসতা বাড়ায় সেখানকার পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি ঘটছে। এখন প্রতিটি বিলম্বিত দিন মানে ফিলিস্তিনে আরও প্রাণহানি।
একজন ফিলিস্তিনি ছাত্রী বার্তা পাঠিয়েছেন এই বলে, ‘আমরা বাংলাদেশে এসে পড়াশোনা করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এখনো কি আশা আছে?’