২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজার এলাকা থেকে নিখোঁজ হন কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন। তাকে হারিয়ে ১৫ বছরের মেয়ে আর ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে সংকটে পড়েছেন স্ত্রী নাসরীন জাহান। কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিলেও করোনায় বন্ধ হয়ে যায় সেটি। স্বামীর ব্যাংক হিসাবে কিছু টাকা আছে; কিন্তু তিনি জীবিত, না মৃত নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত টাকা তোলা যাচ্ছে না। স্মৃতি আকড়ে ধরেই হতাশায় অপেক্ষা করছেন তার স্বজনরা।
স্বজনদের বক্তব্য দেখতে ক্লিক করুন
খোঁজ মেলেনি ২০০ জনের
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর ৬১৪ জন নিখোঁজ বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। জীবিত ও মৃত অবস্থায় ওই ব্যক্তিদের বেশির ভাগের খোঁজ মিললেও অন্তত ২০০ জন এখনো নিখোঁজ।
পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে গুমের ঘটনা কমে গেছে। চলতি বছরের সাত মাসে তিনজন এবং গত বছর মাত্র দুজন নিখোঁজ হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গুমের ঘটনা কমলেও আগের ঘটনাগুলোর রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় আইনের শাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করে তদন্ত এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারের দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা।
এমন এক পরিস্থিতিতে আজ ৩০ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম থেকে সবার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত হয়। চলতি মাসেই বাংলাদেশের ৮৬টি গুমের তথ্য তুলে ধরেছিল নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)। আজ গুম প্রতিরোধ দিবসে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনে বাংলাদেশে গুমের অভিযোগ নিয়ে ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
'গুমের দায় সরকারের'
গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর অসহায়ত্বের দায় সরকারকেই নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আন্তর্জাতিক গুম বিরোধী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, এখানে অনেকে আছেন যে, ৯ বছর ১০ বছর ধরে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, ঢাকার কমিশনার চৌধুরী আলমসহ ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী গুম হয়ে গেছেন।
সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা বলেন যে, এখানে এগুলো (গুম) হয় না। তাহলে গুম হওয়া মানুষগুলো গেলো কোথায়? দায়িত্ব তো আপনাদের। খুঁজে বের করেন তাদেরকে। তাদের পরিবারের কাছে একে একে ফেরত দিন।
'ক্ষমতায় থেকে সরকার এখন হৃদয়হীন'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুম হওয়া পরিবারের কষ্ট বুঝেন কি না, তা জানতে চেয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেছেন, যদি কষ্ট বুঝেন, তবে একটা মানুষ ৮-১০ বছর ধরে তার প্রিয়জনের খোঁজ পাবে না কেন? যেই সরকার এখন ক্ষমতায়, তারা হৃদয়হীন।
স্মরণ সভায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্ট্রি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, উনার (প্রধানমন্ত্রী) উচিত পদ ছেড়ে দিয়ে ওনার বোন রেহানাকে এনে আরো লোকজন দিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, তার পিতার মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের লোকজন কাঁদে নাই, যতটা না আমরা কেঁদেছি।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা আপনি বুঝেন। তাই দ্রুত গুম হওয়া ব্যক্তিদের তাদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, গুম একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। এই বাংলার মাটিতে গুমের বিচার হবেই। আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, যতদিন পর্যন্ত বিচার না পাওয়া যাবে ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
আলোচনা সভায় বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। গুমের শিকার হওয়া তাদের প্রিয় মানুষটির ছবি বুকে নিয়ে তারা আলোচনা সভায় অংশ নেন। এ সময় স্বজনরা কান্না জড়িত কণ্ঠে সরকার ও প্রশাসনের কাছে গুম হওয়াদের ফেরত দিতে দাবি জানায়।