সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২, ০২:৪৩ এএম
প্রয়াত ড. আকবর আলি খান ছিলেন সাবেক সচিব, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক বা এসডিও ছিলেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেন। ভার্সেটাইল প্রতিভার অধিকারী ড. আকবর আলি খান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোর সমর্থক। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি)শিক্ষকদের মধ্যে কে রাজাকার আর কে নয় তা নিয়ে রেষারেষি দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময়ের শিক্ষামন্ত্রীকে ডেকে এ বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিলে এর দায়িত্ব আকবর আলি খানের ওপর হস্তান্তর করা হয়।
রাজাকারদের জন্য তখন একটি আইন প্রচলিত থাকায় এবং সে আইনের অধীনে এ তদন্ত সম্ভব নয় বলে আকবর আলি খান নির্দেশানুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন পরিবেশন করে তার অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে তার নোটসহ তদন্ত প্রতিবেদন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতির কাছে গেলে তিনি বিষয়টি অনুধাবন করেন। তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে ডেকে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে (বঙ্গবন্ধু) বুঝিয়ে বলার পরামর্শ দেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, যখনই যা আমার কাছে পছন্দ বা আইনসিদ্ধ মনে হয়নি আমি লিখিত নোট দিয়েছি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা বলছে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা গৃহীত হতে বাধ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কূটনীতিবিদ, সচিব ও বিশ্বব্যাংকে চাকরি
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকার তার অনুপস্থিতিতে তার বিচার করে এবং ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি সরকারি চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। পরবর্তীতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন না হবার আশঙ্কায় তিনি তিনজন উপদেষ্টার সাথে একযোগে পদত্যাগ করেন।[ তিনি রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে চাকরি ছেড়ে তিনি শিক্ষকতায় যোগদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দিলেও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তাকে অবসর না দিয়ে শিক্ষকতা করার জন্য ছুটি দেয়া হয়।
কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য মনোনীত হবার আগে তিনি অল্প সময়ের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বৃত্তির জন্য তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে অর্থনীতি বিভাগে মাস্টার্স এবং পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭৯ সালে দেশে ফেরত আসার পরে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তাকে আবারো প্রশাসনের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যোগ দেবার জন্য আহ্বান জানানো হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি সাভারের বিপিএটিসি-তে মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ (এমডিএস) হিসেবে যোগ দেন। অত:পর ১৯৮৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশন সচিবালয়ে কাজ করেন।
তিনি ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসে মিনিস্টার (ইকনমিক) পদে যোগ দেন। ঢাকায় ফিরে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগে অতিরিক্ত সচিব পদে যোগ দেন। তার সময়ে তিনি বিসিসিএল ব্যাংকের পূনর্গঠন এবং বেসিক ব্যাংক অধিগ্রহণের কাজ করেন।
১৯৯৩ সালে ড. আলী খান পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি অর্থ সচিব হিসাবে পদস্থ হন। ২০০১ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে বিকল্প কার্যনির্বাহী পরিচালক (অল্টারনেটিভ এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর) পদে যোগদান করেন। বিশ্ব ব্যাংকে তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদে পদত্যাগ
২০০৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন ড. আলি আকবর খান। তবে বিএনপি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত কোন জ্যেষ্ঠ ও বিশেষজ্ঞ ধরনের কাউকে নিয়োগ দেয়নি। বরং মোখলেসুর রহমান চৌধুরীকে নিয়োগ দিয়ে আরও কাঁচা কাজ করেছিল। ড. আকবর আলি খানসহ কয়েকজন বিশিষ্ট উপদেষ্টা তার বিরুদ্ধে ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তির’ অভিযোগ এনে পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। অথচ বিএনপি এধরনের একটি সম্ভাব্য অবস্থার উদ্ভব ঘটার কথা কল্পনাই করতে পারেনি। মূলত আকবর আলি খানসহ কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগের ফলে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাগ করে। পরের দিন (১২ই জানুয়ারি) ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
আলোচিত-সমালোচিত আকবর আলি খান
ড. আকবর আলি খান ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ‘টক শো’তে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। ২০১৪'র মার্চ মাসে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে যত ক্ষমতা মুঘল সম্রাটেরও তত ক্ষমতা ছিলনা।”
৫ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত ১০ম সংসদীয় নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক অনুষ্ঠিত হলেও নৈতিকভাবে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয় নি। ১৫৩ টি আসনে নির্বাচনই হয়নি। ১৪৭ টি আসনে নির্বাচন হলেও ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি।"
২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সে ‘এটিএন বাংলা এবং গণতন্ত্রের জন্য বিতর্ক’ আয়োজিত রম্য সংসদীয় বিতর্ক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অন্য এক অনুষ্ঠানে ড. আকবর আলি খান বলেন, "বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আজ দেশ থেকে নির্বাসিত। মানুষকে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার কোন তাৎপর্য নেই।"
২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, "সংবিধান মানুষের জন্য, মানুষ সংবিধানের জন্য নয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।"
নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিমগ্ন আকবর আলী খান দেশের ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি নিয়ে গবেষণা করছেন। একই সঙ্গে তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে গবেষণা করছেন ।
প্রসঙ্গত, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বৃহস্পতিবার রাত ১০টার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।