যেভাবে বীরশ্রেষ্ঠ হলেন মতিউর রহমান,মুন্সী আবদুর রউফ ও নূর মোহাম্মদ শেখ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ১৬, ২০২১, ০৮:৫৫ পিএম

যেভাবে বীরশ্রেষ্ঠ হলেন মতিউর রহমান,মুন্সী আবদুর রউফ ও নূর মোহাম্মদ শেখ

দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। যুদ্ধে অতুলনীয় সাহস এবং আত্মত্যাগের প্রদর্শনের মাধ্যমে এ জাতি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধে এই আত্মত্যাগ এবং অপরিসীম বীরত্বের নিদর্শনস্বরূপ সাত যোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিজয়ের এই মাসে আমরা নিয়ে এসেছি এই সাত যোদ্ধার গল্প। তৃতীয় পর্বে আজ থাকছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের কথা।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিউর রহমান পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ছুটিতে দেশে এসে প্রথমে একবার তিনি স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছিলেন, এমনকি ভৈরবে তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। পরে পরিবারের চাপে মে মাসে পাকিস্তানে ফেরত চলে যান।

তবে যুদ্ধে যোগদানের চিন্তা তার মাথায় সবসময়ই ছিলো। পাকিস্তান থেকে বিমান ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেন তিনি, লক্ষ্য ছিলো সেটি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া।

২০ আগস্ট সকালে করাচির মশরুর বিমানঘাঁটি থেকে পাঞ্জাবি পাইলট অফিসার মিনহাজ রশীদের টি-৩৩ বিমান নিয়ে উড়বার শিডিউল ছিল। মতিউর ছিলেন তার প্রশিক্ষক। টি-৩৩ বিমানের সাংকেতিক নাম ছিল ব্লু বার্ড। পরিকল্পনা করে মতিউর রহমান এইদিন প্রশিক্ষণকালে উড্ডয়নরত অবস্থায় বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নিতে চেয়েছিলেন।

তবে অপর পাইলটের সাথে তার বিমানের কন্ট্রোল নিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে বিমানটি বিধ্বস্ত হয় ভারতীয় সীমান্তের কাছে থাট্টায়। মতিউরের মৃতদেহ ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পাওয়া গেলেও মিনহাজের লাশের কোন হদিস মেলে নি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা মতিউর রহমানের মৃতদেহ উদ্ধার করে অত্যন্ত অমর্যাদার সাথে দাফন করে মশরুর বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কবরস্থানে। মতিউর রহমানের দেশপ্রেম ও আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সামরিক সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়। শাহাদতের ৩৫ বছর পর ২৪শে জুন ২০০৬ মতিউরের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবর স্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়।

ঢাকার আগাসাদেক রোডস্থ পৈতৃক বাসভবনে ১৯৪১ সালের ২৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।

এরপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে সারগোদার পাকিস্তান বিমানবাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমীতে যোগ দেন।

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুন্সী আবদুর রউফ ইপিআর এর ১১ নং উইং, চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চ কালরাতে এদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর চালানো গণহত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম ইপিআর এর সদস্যরা বিদ্রোহ করে ৮ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগ দেন।

ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর-এর ১৫০ জন সৈনিককে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথে নিরাপত্তাব্যুহ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দলের এক নম্বর এলএমজি চালক মুন্সী আবদুর রউফ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়ারচর উপজেলাধীন বাকছড়ির একটি বাঙ্কারে।

৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৭টি স্পিডবোট ও ২টি লঞ্চ সহযোগে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথের আশেপাশে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আন্দাজ তাদের ওপর লঞ্চ থেকে মর্টারে গোলাবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানী বাহিনী। অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে এই সুযোগে কিছু পাকিস্তানি সৈন্য তীরে নেমে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ঘিরে ফেলে।

ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান পেছনে হটার সিদ্ধান্ত নেন। নিরবিচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ার দেয়ার জন্য মুন্সী আবদুর রউফ থেকে যান পেছনে। মুন্সী আবদুর রউফের এলএমজির কাভারিং ফায়ারে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তাঁর সৈন্যদের নিয়ে পেছনে হটতে থাকেন।

মুন্সী আবদুর রউফের নিখুঁত ফায়ারিং এ পাকিস্তানী বাহিনীর স্পিডবোটগুলো ডুবে যায় এবং সেগুলোতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা হতাহত হয়। বাকি সৈন্যরা লঞ্চ দুটিতে করে পালাতে থাকে। এলএমজির রেঞ্জের বাইরে গিয়ে লঞ্চ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা মর্টারে গোলা বর্ষণ করতে থাকে।

অসম সাহসী আবদুর রউফ তখনো গুলি চালানো অব্যাহত রেখেছিলেন। অকস্মাৎ শত্রুর একটি গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মুন্সী আবদুর রউফের দেহ। সহযোদ্ধারা পরে তাঁর লাশ উদ্ধার করে নানিয়ারচরের চিংড়ি খাল সংলগ্ন একটি টিলার উপর সমাহিত করে।

১৯৪৩ সালের ৮ মে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার সালামতপুর গ্রামে জন্ম জন্মগ্রহণ করেন মুন্সী আবদুর রউফ। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। সংসারের অভাব দেখে আবদুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ মে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল্সে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়োগ পান পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে।

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ও আত্মদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে সিপাহী মুন্সী আবদুর রউফকে অনরারি ল্যান্স নায়েক পদে মরনোত্তর পদোন্নতি দান করে।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীতে কর্মরত নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে নূর মোহাম্মদ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি যশোর ৮ নং সেক্টরে যুদ্ধরত ছিলেন।

একটি স্থায়ী টহল-দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করছিলেন নূর মোহাম্মদ শেখ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য সুতিপুর প্রতিরক্ষার অগ্রবর্তী এলাকা গোয়ালহাটিতে নিয়োজিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এই টহল দলটি।

টহল পার্টিটির অস্তিত্ব টের পেয়ে ৫ সেপ্টেম্বর পাকসেনারা অতর্কিতে টহল-দলটিকে ঘিরে তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। মাত্র তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে নূর মোহাম্মদ পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে শুরু করেন।

যুদ্ধরত অবস্থায় পেছনে সরতে চেষ্টা করে টহল দলটি। হঠাত নূর মোহাম্মদ শেখ আহত হলে আরেক সহযোদ্ধা তাকে কাঁধে নিয়ে পিছু হটতে শুরু করেন। নূর মোহাম্মদকে বহনকারী সহযোদ্ধাও আহত হলে তাকে জোর করে দলের সাথে পাঠিয়ে সাথীদের পালানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্য কাভারিং ফায়ারের দায়িত্ব নেন নূর মোহাম্মদ শেখ। আহত অবস্থায় লড়তে লড়তেই তিনি শহীদ হন।

তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে সীমান্তবর্তী কাশীপুরে সমাহিত করে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের জন্ম ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬, যশোর জেলার অর্ন্তঃগত নড়াইল মহকুমার মহিষখোলা গ্রামে। শৈশবেই বাবা-মা হারিয়ে অনেকটা সংসার বিরাগী জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। সংসারের প্রতি মন ফিরিয়ে আনতে অবিভাবকরা তাঁকে ১৯৫২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করান।স্ত্রী তোতা বিবির বয়স তখন ১২ বছর।

১৯৫৪ সালের শেষভাগে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান হাসিনা খাতুন। পরবর্তীতে সংসারের হাল ধরতে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯, তদানিন্তন ইপিআর-এ সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর ইপিআর ক্রমিক নম্বর ছিল ৯৪৫৯। ১৫ই নভেম্বর ১৯৬৪, জন্মগ্রহণ করে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান শেখ মোঃ গোলাম মোস্তফা কামাল।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি নিজ গ্রামের বাড়িতে ছুটিতে ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে বিদ্রোহ করে তিনি যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।

Link copied!