ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২২, ০৬:৫৯ পিএম
ইরান থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপে পৌঁছার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন পারভিন৷ তুরস্ক থেকে গ্রিসে পৌঁছাতে পারলেও ছয়বার তাকে পুশব্যাক করে তুরস্ক ফেরত পাঠানো হয়৷ সপ্তমবারের চেষ্টায় তিনি জার্মানি পৌঁছাতে সমর্থ হন৷ কিন্তু যাত্রার প্রতি মুহূর্তে তিনি গ্রিসের সীমান্তরক্ষীদের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন৷ ঘটনার বিচার চেয়ে পারভিন গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানিয়েছেন তার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা৷
‘‘আমার নাম পারভিন৷ ২০১৭ সালে আমি ইরান থেকে তুরস্ক যাই৷ তারপর সেখান থেকে আমি ইউরোপে পৌঁছাই৷ কিন্তু ইউরোপে পৌঁছানোর পথে গ্রিস থেকে অন্তত ছয়বার আমাকে পুশব্যাক অর্থাৎ জোর করে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷’’
৩০ বছর বয়সি ইরানের পারভিন বর্তমানে জার্মানিতে অবস্থান করছেন৷ কিছুদিন আগে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস-এর (ইসিসিএইচআর) টুইটার পাতায় একটি ভিডিও পোস্ট করেন পারভিন৷ ভিডিওতে ইরান থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশী হিসেবে জার্মানি আসার পথে কিভাবে গ্রিসের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এই নারী৷
তারপর ইসিসিএইচআর ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, গবেষণা সংস্থা ফরেনসিক আর্কিট্যাক্ট, লন্ডনের গোল্ডস্মিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি দল এবং জার্মান নিউজ ম্যাগাজিন ডেয়ার স্পিগেল-এর সহযোগিতায় পারভিনের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাটি প্রকাশিত হয়৷
‘‘আমি সাঁতার জানি না৷ তবুই আমি তুরস্ক থেকে এভরোস নদী পার হওয়ার চেষ্টা করি৷ আর তখন গ্রিসের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে আটক হই৷ তারা আমাদেরকে একটি নোংরা কন্টেইনারে আটকে রাখে৷ কোনো আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নেই সেখানে৷ নেই খাবার, কিংবা টয়লেট৷
পারভিনের দাবি, সেসময় গ্রিসের নিরাপত্তারক্ষীরা তিনি ও তার সাথে থাকা অন্য বন্দিদের মারধর করে৷
‘‘তারা আমাকে মারধর করল৷ আমাদের সাথে থাকা শিশুদের এবং গর্ভবতী নারীদেরও তারা মারধর করল৷ আমাদের খাবার এবং কাপড়চোপড় নিয়ে গেল৷ আমাকে হাতকড়া পরানো হলো, নির্যাতন ও মারধর করা হলো- প্রায় মেরেই ফেলছিল৷’’
‘সবকিছু গোপনে করা হলো’
টুইটারে দেওয়া ভিডিওতে পারভিনের শরীরে আঘাতের চিহ্নগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷
তিনি বলেন, ‘‘সবকিছুই গোপনে করা হচ্ছিল৷ তবে আমি নির্যাতনের কিছু ছবি উঠিয়ে রাখতে পেরেছিলাম৷ যেন প্রমাণ করতে পারি, আমার উপর কী নির্যাতনটাই না হয়েছে৷’’
নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এসব নির্যাতনের বিষয়টি সবাইকে জানাতে চান পারভিন৷ কারণ তিনি ‘ন্যায়বিচার’ চান৷ ‘‘মানুষ হিসেবে আমার যে অধিকার তার স্বীকৃতি চাই আমি৷ আর আমি চাই এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন হোক৷’’
‘মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল’
ডেয়ার স্পিগেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পারভিন জানান, কাঠ দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়৷
তিনি বলেন, ‘‘আঘাতের পর আমার মনে হলো মুখ দিয়ে পানির মতো রক্ত ঝরছে৷’’
এদিকে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখের কথা আলাদাভাবেই উল্লেখ করেন পারভিন৷ আফগানিস্তান ও ইরান থেকে আসা আরো ১৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর সাথে যাত্রা করছিলেন তিনি৷ সেদিন গভীর রাতে তুরস্কের এড্রিনের নিকটে অভরোস নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তারা৷
পারভিনের ভাষ্য মতে, ১৩ জনের এ দলটি এক পর্যায়ে গাছের ফাঁকে লুকিয়ে ছিলেন৷ নদী পাড়ি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর তারা সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে৷
পারভিন বলেন, ‘‘সীমান্তরক্ষীদের একজন আমার পিঠের ব্যাগটি নিয়ে নেয়৷ ব্যাগের ভেতর কাগজে মোড়ানো এক হাজার ইউরো ছিল৷’’
নিরাপত্তারক্ষীরা সেসময় তার শীতের পোশাকটিও নিয়ে নেয় বলে জানান পারভিন৷ তবে মোবাইল ফোনটি তিনি প্রথমে অন্তর্বাসের ভেতর ও পরে জুতোর ভেতর লুকিয়ে লেখেছিলেন৷ এ কারণে তারা ফোনটি দেখতে পায়নি বলে জানান পারভিন৷
চলতে থাকে নির্যাতন
পারভিনের দাবি, গ্রিস কর্তৃপক্ষ তাকে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার সুযোগ দেয়নি৷
গ্রিসে আটক থাকা অবস্থায় নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে পারভিন আরো জানান, আটকে রাখার এক পর্যায়ে নিরাপত্তারক্ষীরা পারভিন ও তার সাথে থাকা অন্যদের বাইরে নিয়ে আসে৷ এসময় তাদেরকে বিবস্ত্র করে তল্লাশি চালানো হতে পারে এমন আশঙ্কা করেন পারভিন৷ আর এ কারণে তিনি চিৎকার করতে থাকেন৷
পারভিনের বলেন, ‘‘চিৎকার করতে থাকলে এক নিরাপত্তারক্ষী বন্দুক দিয়ে নাকে আঘাত করে৷’’
পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে পারভিন জানান যে, তাকে তখন আলাদা একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ‘‘অন্ধকার এ রুমটিতে একটু একটু আলো আসতো আর মেঝেতে ছিল কাঠের লাঠি৷’’
পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে পালানোর চেষ্টা করেন পারভিন৷ কিন্তু ব্যর্থ হলে তার উপর নির্যাতন বাড়তে থাকে৷ পারভিনের জানান, পালানোর চেষ্টাকালে দুইজন লোক তাকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং তার পা ও পিঠে আঘাত করে৷
‘‘চোখ বন্ধ করে আমি চিৎকার করছিলাম৷ আমার আমার নাক দিয়ে তখন রক্ত ঝরছিল৷ আমি তখন প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছিলাম৷’’
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইরানের এ নারী অভিবাসনপ্রত্যাশী আরো জানান, তাকে রুমের মাঝখানে একটি চেয়ারে বসানো হয় এবং হাতকড়া পড়ানো হয়৷ তার দাবি, তিনি বার বার পানি খেতে দেওয়ার অনুরোধ করছিলেন এবং টয়লেটে যেতে দেওয়ার অনুরোধ করছিলেন৷ কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি৷
এর কিছুক্ষণ পর পারভিনকে আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয় আর সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাকি বন্দিদের কাছে৷
পরদিন সকালে পারভিনসহ বাকিদেরকে এভরোস নদীর কাছে নিয়ে আসা হয়৷ যে লোকগুলো তাদেরকে নিয়ে এসেছিলেন তাদের গায়ে সামরিকবাহিনীর মতো করে পোশাক ছিল বলে দাবি পারভিনের৷
তাদের একজন পারভিনের হাত এবং ঘাড় চেপে ধরে বলল, তুমি যদি আবার এখানে আস তাহলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে৷ তারপর একটি ডিঙিতে চড়ে নদী পার হয়ে তারা তুরস্ক সীমান্তে আসে৷
এভাবে ছয়বার চেষ্টার পর গ্রিস হয়ে জার্মানিতে পৌঁছাতে সমর্থ হন পারভিন৷ ইতিমধ্যে জার্মানিতে আশ্রয় আবেদন করেছেন ইরান থেকে আসা এই নারী৷
ইসিসিএইচআর-এর আইনজীবীরা তাকে তার অভিযোগের সমর্থনে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি যোগাড়ে সাহায্য করছে৷ গ্রিসের সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে পারভিনের এ অভিযোগ জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে পাঠানো হবে৷
পারভিনের অভিযোগের বিষয়ে ইতিমধ্যে একটি তদন্ত করেছে ইসিসিএইচআর৷
নির্যাতনের বিচার চাওয়ার বিষয়ে যাত্রাপথেই পরিকল্পনা করেন তিনি৷ পারভিন বলেন, ‘‘একবার পুশব্যাকের সময় আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে যখন ইউরোপে পৌঁছাবো তখন আমি এর বিচার চেয়ে আদালতে যাব৷
স্পিগেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পারভিন বলেন, ‘‘আমি চাই যে আমার উপর হওয়া নির্যাতনের বিষয়টি সবাই জানুক৷ আর সীমান্তের পুশব্যাক কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার পর আমি একবার সেখানে যেতে চাই৷’’
সূত্র: ইনফো মাইগ্রেন্টস বাংলা