সেপ্টেম্বর ২, ২০২১, ০৩:৩৪ পিএম
আফগানিস্তান থেকে শেষ মার্কিন সৈন্যটিও বিদায় নিয়েছে। হঠাৎ এবং দ্রুত মার্কিন ও তার মিত্রদেশগুলোর আফগানিস্তান ত্যাগকে তালেবানরা আখ্যা দিয়েছে ‘স্বাধীনতা’ হিসেবে এবং আফগানিস্তানকে ঘোষণা করেছে মুক্ত ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু আদৌ কি আফগানিস্তান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে?
সম্ভাবনার দিকে যাওয়ার আগে আমরা আফগানিস্তানে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেই। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো বহু গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে উঠা আফগানিস্তানে তালেবান ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী আছে। সেগুলোর সাথে তালেবানের সম্পর্ক কেমন হবে এবং ক্ষমতায় গিয়ে তালেবান এসব গোষ্ঠীর সাথে কি আচরণ করবে সেটাই দেখার বিষয়।
তালেবান আফগানিস্তানের ৩৪ টি প্রদেশের মধ্যে ৩৩ প্রদেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও পাঞ্জশির প্রদেশ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গেছে। সেই প্রদেশটি নিয়ন্ত্রণ করছে পাঞ্জশির ন্যাশনাল রেসিসটেন্স ফোর্সের (এনআরএফ)। দলটির নেতা আহমাদ মাসুদ যিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী এক নেতৃস্থানীয় মুজাহিদ। সম্প্রতি তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করতে প্রস্তুত বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে তালেবান পাঞ্জশির প্রদেশে হামলা করলে তার ফলাফল ভালো হবে না বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেনে মাসুদ।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যগুলোর প্রতিবেদনে আফগানিস্তানের বিভিন্নস্থানে তালেবান প্রতিরোধের অহরহ খবর উঠে আসছে। ইতোমেধ্যে আফগানিস্তানের খোরাসান শাখা ইসলামিক স্টেট (আইএস) মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সবমিলিয়ে আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে তালেবান কি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে তালেবান যদি আফগানিস্তান শাসনে মধ্যপন্থা অবলম্বন এবং সাধারণ ক্ষমার ঘোষণায় অটল থাকে তবে আফগানিস্তান হয়তো গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যাবে। তবুও একাধিক জাতিগোষ্ঠীর এই দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য তালেবানকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে-এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
আফগানিস্তানের দ্বিতীয় যে সমস্যা তা হলো দেশটিন কৃষি এবং খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা। এই দুইক্ষেত্রেই আফগানিস্তানের অবস্থা এত নাজুক যে, দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটের মুখে। ক্রমবর্ধমান ক্ষরা এই সঙ্কট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। সাথে যুক্ত হয়েছে তালেবানের সাথে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর অনাস্থার সম্পর্ক। ফলে কেবল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নয় বরং দেশটির প্রতিটি নাগরিকের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায় নিয়ে তালেবানকে অবশ্যই অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে আস্থায় এনে তাদের শাসনকার্যে সম্পৃক্ত করে এক ঢিলে দুই পাখি মারা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প খোলা নেই। শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে এমন নয়।
২০১০ সালে মার্কিন সামরিক বাহিনী ও তাদের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের চালানো এক সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়, আফগানিস্তানে প্রায় ১ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের খনিজ সম্পদ আছে। এসব খনিজ আগমীদিনে বিশ্ব অর্থনীতির চালিকা শক্তি হয়ে উঠবে। ফলে আগামি দিনে আফগানিস্তানের অর্থনীতি কোন কোন দিককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে এবং দেশটিতে আন্তর্জাতিক স্বার্থ কোন বিষয়কে কেন্দ্র কর আবর্তিত হবে সেটা সেহজেই অনুমেয়।
এদিকে, শর্তসাপেক্ষে তালেবানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে চীন । তবে সেই শর্ত কাবুল কতোটা মানবে এবং শর্ত মানাতে বেইজিং তালেবানের ওপর কতোটা কঠোর হবে তাই এখন মূখ্য বিষয়। এখানে শি জিনপিং প্রশাসনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। রাশিয়া এবং আমেরিকার মতো চীনের গায়ের জোরে নয় বরং টাকা ছড়িয়ে কাবুলে জেঁকে বসতে চায়। কে না জানে চীনের সেই আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সামর্থ্য আছে? তাছাড়া, আফগানিস্তানে ঢোকার দৌঁড়ে দৃশ্যত এখন অবধি চীন এগিয়ে আছে। ভারতের সাথে তালেবানের সাপে-নেউলে সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। ফলে আফগানিস্তানের মাটিতে ভারতের প্রবেশ ঠেকাতে চীন-তালেবান যৌথভাবে কাজ করবে-এমনটাই স্বাভাবিক।
এছাড়া বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বাকী থাকে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রাশিয়া আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি বা মাতাব্বরি যাই বলি না কেন সেটি নিশ্চিত করতে তিন বৃহৎ শক্তি চীন-যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া মিলে ট্রয়কা গঠন করেছিল। কিন্তু এখন অবধি এই ট্রয়কার কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আফগানিস্তানে দেখা যায়নি। ফলে দৌঁড়ে এই তিন দেশের মধ্যে যে চীনই এগিয়ে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি তালেবানের কাছে হস্তান্তর করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র যে সহসা তালেবানকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে না তা নিশ্চিত। একইসাথে ইইউ বলেছে তারা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। এর বাইরে অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে আফগানিস্তানে তাদের উপস্থিতি ধরে রাখতে। তালেবানের পুরনো মিত্র ইরান এখনো চুপ রয়েছে। মার্কিন অবরোধে জর্জরিত ইরান যে তালেবানের সাথে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে আরো বাড়িয়ে নেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফলে আগামী দিনে, আফগানিস্তান শাসন করতে গিয়ে তালেবানকে ঘরে এবং বাইরে দুই ফ্রন্টেই যুদ্ধ করতে হবে। এই যুদ্ধ হবে কূটনৈতিক এবং এই যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানে তালেবান এবং আফগানিস্তান দুটোর ভাগ্যেই আবার বিপর্যয় নেমে আসা।
তালেবানের পেছনে দৃশ্যত চীন, পাকিস্তান, ইরান থাকলেও আফগানিস্তান শাসন করতে গিয়ে ভয়াবহ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হবে তারা। কেননা একটি দেশ চালানোর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাদের থাকলেও ইসলামি শরিয়া শাসন ব্যবস্থার সাথে আন্তর্জাতিক অর্থ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কিভাবে তারা খাপ খাইয়ে চলবে তাও জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তবে গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর তালেবান যে অংশগ্রহণমূলক শাসন ও সরকার গঠনের কথা বলে আসছে তাতে অটল থাকলে তাতে তালেবানের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। হয়তো কেবল দুষ্প্রাপ্য খনিজগুলোই আফগানিস্তানের সাথে অন্যান্য বড় দেশগুলোর সম্পর্ক তৈরি করবে। ট্রয়কা যদি তার উদ্দেশ্য অর্থাৎ একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে, তালেবান যদি তাদের অন্তরায় না হয় এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য অংশীদারদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে তবে একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তান আমরা আশা করতে পারি।