মে ২২, ২০২৫, ০৪:০২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ওভাল অফিসে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এবার নাস্তানাবুদ হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ড সিরিল রামাফোসা। এর আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ক্ষেত্রে এরকম দেখা গিয়েছি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, বুধবার ওভাল অফিসে হোয়াইট হাউজ মঞ্চায়িত এ ‘নাটকের’ উদ্দেশ্যই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টকে ‘চেপে ধরা’, যা ফেব্রুয়ারিতে একই অফিসে জেলেনস্কির সঙ্গে হওয়া ঘটনার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে।
আলো কমিয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাকে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে নাস্তানাবুদ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভূ-রাজনৈতিক কী সুবিধা হাসিল করতে পারবেন তা এখনও স্পষ্ট না হলেও তিন মাসের মধ্যে দুই বিশ্বনেতাকে এভাবে অপদস্ত হতে দেখে অনেক বিশ্বনেতাই যে এখন হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি হতে ‘দুইবার ভাববেন’ তা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।
ট্রাম্প এদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের ওপর ‘গণহত্যা চালানো হচ্ছে’ এমন মিথ্যা অভিযোগ তুলে রামাফোসার মুখোমুখি হন। আফ্রিকার দেশটিতে শ্বেতাঙ্গদের নির্বিচারে হত্যা ও তাদের জমি দখল করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ঐতিহাসিকভাবে ওভাল অফিসটি বিদেশি অতিথিদের সম্মান জানানোর স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু ট্রাম্প এখন এই কার্যালয়কে তুলনামূলক দুর্বল দেশের অতিথিদের বিব্রত করা কিংবা চাপে ফেলার জায়গা বানিয়ে ফেলতে চাইছেন বলেই মনে হচ্ছে।
এ কারণে এখন অনেক দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দ্বিধায় থাকবেন। বলা তো যায় না, ট্রাম্প কখন কাকে প্রকাশ্যে অপমান করে বসেন কিংবা এমন পরিস্থিতিতে ফেলেন যা বিব্রতকর।
সেক্ষেত্রে মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে; তাও এমন এক সময়ে যখন চীন অনেক মার্কিন মিত্র ও অংশীদারদের কাছে টানতে চাইছে।
বারাক ওবামা মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে দক্ষিণ আফ্রিকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা প্যাট্রিক গ্যাসপার্ড বলেছেন, “রামাফোসার সঙ্গে বৈঠককে ট্রাম্প লজ্জাজনক নাটকে পরিণত করেন, মিথ্যা চাতুরিপূর্ণ চলচ্চিত্র ও উত্তেজক কথাবার্তা বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন।”
“ট্রাম্পের শর্তে আলোচনা কারো জন্যই ভালো হয় না,” এক্সে এমনটাই লিখেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেসের জ্যেষ্ঠ ফেলো গ্যাসপার্ড।
অথচ ওভাল অফিসের এই বৈঠকটিকে দেখা হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্ক মেরামতের একটি সুযোগ হিসেবে; ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ ও ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’ নিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব প্রকট করেছে।
বুধবারের বৈঠকের শুরুটা ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ, কিন্তু টিভিতে রিয়েলিটে শো-র সাবেক উপস্থাপক ট্রাম্প কক্ষের আলো কমিয়ে দিতে বলেন এবং তারপর একটি ভিডিও ও কিছু ছাপা নিবন্ধ দেখিয়ে সেগুলোকে শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের ওপর নিপীড়নের প্রমাণ অ্যাখ্যা দেন।
ট্রাম্পের এমন অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য রামাফোসা প্রস্তুতই ছিলেন, যদিও এমন নাটকীয়তা হয়তো তিনি প্রত্যাশা করেননি। তিনি শান্ত ও সংযতভাবে সব শুনে যুক্তির মাধ্যমে ট্রাম্পের দাবি খণ্ডনের চেষ্টা করেন এবং ‘অল্পতেই চটে যেতে পারেন’ এমন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো বা সমালোচনা থেকে বিরত থাকেন।
“আমি দুঃখিত যে আপনাকে দেওয়ার মতো কোনো উড়োজাহাজ আমার নেই,” ট্রাম্পকে কাতারের দেওয়া বিলাসবহুল জেট বিমান উপহার দেওয়ার বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে হাসিমুখে করা রসিকতায় বলেন রামাফোসা।
তার মুখপাত্র ভিনসেন্ট মাগোয়েইনিয়া পরে দক্ষিণ আফ্রিকার সম্প্রচারমাধ্যম নিউজরুম আফ্রিকাকে বলেন, “আপনারা দেখেছেন প্রেসিডেন্ট রামাফোসাকে উসকানো হচ্ছিল। তাকে খোঁচানো হচ্ছিল, কিন্তু তিনি সেই ফাঁদে পা দেননি।”
রামাফোসাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই এই বৈঠক আয়োজন করা হয়েছিল কিনা কিংবা এর মাধ্যমে অন্য দেশের নেতাদের এ ধরনের সফরের ক্ষেত্রে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে কিনা, রয়টার্স হোয়াইট হাউজকে এমন প্রশ্ন করলেও তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কাছ থেকে এর কোনো জবাব পায়নি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আরেকটি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো ক্যামেরন হাডসন বলেছেন, “যদিও বৈঠকের টেলিভিশনে প্রচারিত অংশটা অনেকটা সার্কাসের মতো লাগছিল, তবু সেটা কখনো রাগ বা বিষাক্ত বাক্যবাণে গড়ায়নি, ফলত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।”
ফেব্রুয়ারিতে জেলেনস্কির সঙ্গে হওয়া বৈঠকের সঙ্গে এটাই পার্থক্য। তিন মাস আগের ওই বৈঠকে ট্রাম্প, ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকে একে অপরের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করতে দেখা গেছে।
জেলেনস্কিও রামাফোসার মতোই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে চেয়ে ওভাল অফিসে গিয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন সামরিক সহায়তা আগের মতো অব্যাহত রাখা।
সেখানে ট্রাম্প তাকে এমনভাবে চেপে ধরেন যে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট সংযত থাকতে পারেননি। ট্রাম্প সেদিন জেলেনস্কির বিরুদ্ধে ‘অশ্রদ্ধা দেখানো’, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলার অভিযোগ করেন।
সেদিনের সেই বৈঠক যুক্তরাষ্ট্রের নেটো মিত্রদের ‘জোর ধাক্কা’ দিয়েছিল। বুধবারের বৈঠক সেদিক থেকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ওয়াশিংটনের জন্য এটা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে আফ্রিকা মহাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় দক্ষিণ আফ্রিকা বেশ প্রভাবশালী।
চীন দেশটির প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়।
ঔপনিবেশিক শাসন ও বর্ণবাদের দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে ১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরে বহুদলীয় গণতন্ত্রে পৌঁছানো দক্ষিণ আফ্রিকা ট্রাম্পের আনা সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প মূলত তার সমর্থকদের মধ্যে কট্টর-ডান ও শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী অংশকে খুশি করার জন্যই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যার’ অভিযোগ আনছেন এবং ভূমি সংস্কারকে ‘বর্ণবাদী নিপীড়ন’ হিসেবে দেখাচ্ছেন।
জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর ট্রাম্প এ পর্যন্ত তার সমর্থকগোষ্ঠীকে খুশি করতে দক্ষিণ আফ্রিকার সহায়তা বাতিল করেছেন, দেশটির রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছেন এবং তার ভাষায় ‘বর্ণবাদী নিপীড়নের’ শিকার কিছু সংখ্যালঘু আফ্রিকানার্সকে (শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী, মূলত ডাচ, জার্মান ও ফরাসী অভিবাসীদের বংশধর) যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ও দিয়েছেন।
রয়টার্স লিখেছে, ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ভূমি সংস্কার আইনের ওপর ক্ষ্যাপা।
প্রিটোরিয়া এ আইনটি করেছে বর্ণবাদের সময় হওয়া অন্যায় ও অবিচার প্রতিকারের লক্ষ্যে। এতে জনস্বার্থে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সরকারকে জমি অধিগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তবে ওই জমি ফাঁকা পড়ে থাকলেই কেবল এই সুযোগ তখনই নেওয়া যাবে, তাছাড়া নয়।
কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনো অধিগ্রহণের ঘটনা ঘটেনি। তাছাড়া এ ধরনের যেকোনো অধিগ্রহণকে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানোরও সুযোগ রয়েছে।