আন্দোলনের ফসল যেভাবে ঘরে তুলল ভারতের কৃষক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ২১, ২০২১, ১২:৪৩ এএম

আন্দোলনের ফসল যেভাবে ঘরে তুলল ভারতের কৃষক

২৫ বছরের যুবা মৌমিতা বসু। ভারতের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির (এপিডিআর) একজন একনিষ্ঠ কর্মী তিনি। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল দেশের কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এই কর্মী। তবে আন্দোলনের মাঝপথে ১৯ এপ্রিল হঠাৎ কোভিড আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন মৌমিতা। তারপর আর আন্দোলনে ফেরা হয়নি তার। চলে গেছেন পরপারে। মৌমিতা বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। কেন না, ১৯ নভেম্বর নরেন্দ্র মোদী সরকার কৃষকদের দাবীর মুখে নতি স্বীকার করেছে। জয় হয়েছে কৃষক-জনমানুষের দাবীর।

২০২০ সালের ভারতের ইস্যুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল দেশটির এই কৃষক আন্দোলন। সে বছর ৫ জুন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি নতুন কৃষি আইন পাস করে। যার সার কথা ছিল দেশটির কৃষি খাতকে বেসরকারি বা প্রাইভেট খাতে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু এসব আইন কৃষকদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় দেশটির কৃষকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এক পর্যায়ে দাবী আদায়ে কৃষকরা দিল্লী অভিমুখেও যাত্রা শুরু করে।

কৃষক আন্দোলনে নারী কিষাণ। 

কেন এই আন্দোলন? তা জানার জন্য একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। আগেই বলা হয়েছে, ২০২০ সালে ভারতের আইনসভায় নরেন্দ্র মোদীর সরকারের তিনটি কৃষি আইন পাস করে। সেগুলো ছিল যথাক্রমে:

১. কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন,

২. অত্যাবশ্যক পণ্য আইন এবং

৩. কৃষি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কৃষি পরিষেবা সংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন।

এই তিন কৃষি আইন পাসের পরই তীব্র প্রতিবাদ জানান ভারতের কৃষকেরা। যে পথ ধরে এসেছিল কৃষক আন্দোলনের সাফল্য তা নিয়েই আজকের আলোচনা। 

২০২০ সালের ৫ জুন ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদীর সরকার কৃষি আইনের প্রস্তাবগুলো আনে। পরে ১৪ সেপ্টেম্বর বিল তিনটির বিষয়ে ভারতের পার্লামেন্টে অধ্যাদেশ আনা হয়। তারই জের ধরে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লোকসভায় বিলগুলো পাস হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভাগুলোতে কন্ঠভোটে নতুন আইনগুলো পাস হয়। জনমনে আশঙ্কা ছিল, নতুন আইন রাষ্ট্রায়ত্ত কৃষি ব্যবস্থাকে বেসরকারি খাতে টেনে নিয়ে যাবে।

দিল্লীর আজাদ ময়দানে 

তারই সূত্র ধরে, পাস হওয়া নতুন আইনগুলোর প্রতিবাদে ২৫ নভেম্বর দিল্লি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা। পরে দিল্লি সীমান্তে নিয়মের অজুহাতে দিল্লী পুলিশ তাদের বাধা দেয়। ছোঁড়া হয় জলকামান, কাঁদানে গ্যাস। সেসময় দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কৃষকরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

পরে, ৩ ডিসেম্বর আন্দোলনরত কৃষক এবং সরকার আলোচনায় বসে। কিন্তু কোন সমাধান বের না হওয়ায় ৮ ডিসেম্বর ‘ভারত বন্ধ’ এর ডাক দেন কৃষকরা। তারপরও কোন সিদ্ধান্ত না আসায় ১১ ডিসেম্বর ‘কিসান ইউনিয়ন’ নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল করেন। তারই সূত্র ধরে ১২ জানুয়ারি নতুন তিন কৃষি আইনে স্থগিতাদেশ দেয় দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। সেময় সময় কোর্ট চার সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করার নির্দেশ দেয় যাদের কাজ ছিল দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে সমাধান করার চেষ্টা করা।

তারও প্রায় দুই সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে ছুঁড়লে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দেশটির সুশীল সমাজ কৃষকদের সমর্থন করলে তারা সরকারের তোপের মুখে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করছে। এমনকি দেশের বাইরেও ভারত সরকারকে তোপের মুখে পড়তে হয় তাদের। মার্কিন পপ তারকা রিহানা, পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ভাতিজি মীনা হ্যারিসও ভারত সরকারের সমালোচনায় মুখর হন।

ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের এই পর্যায়ে ২৭ মে আন্দোলনের ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার দিনে ‘কালাদিবস’ পালন করেন আন্দোলনরত কৃষকরা। এ সময় ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের নেতা রাকেশ তিকায়েত ঘোষণা দেন, ‘দরকার হলে ২০২৪ সালে মোদী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত চলবে আন্দোলন’।

এরপর ২০২১ সালের জুলাই মাসে লোকসভায় বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হয়। একই সময়ে, ২০০ জন আন্দোলনকারী কৃষকরা লোকসভা ভবনের বাইরে ‘কিষাণ সংসদ’ বসিয়ে সরকারের সমান্তরালে অধিবেশন শুরু করে। এই পর্যায়ে দেশের ১৪টি বিরোধী দলের নেতা কৃষকদের কিষাণ সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কৃষক আন্দলনে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান।

কৃষকদের ট্রাক্টর র‌্যালি। 

এরপর কার্নালে কৃষকদের উপর লাঠিচার্জ করে হরিয়ানা পুলিশ। পুলিশের লাঠির আঘাতে অনেকেই আহত হন। প্রতিবাদে আইএএস কর্তা আয়ুষ সিংহের স্থগিতাদেশ দাবি করেন কৃষকরা। ক্যামেরায় আয়ুষকে বলতে শোনা গিয়েছিল, একজন কৃষকও যেন ফাটা মাথা ছাড়া ঘেরাটোপের বাইরে বার হতে না পারে!

তবে আন্দোলনে চরম নাটকীয়তা আসে উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলের দ্রুতগামী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে চার কৃষকের মৃত্যু হলে। ঘটনার পর অজয়ের ছেলে আশিস মিশ্রর গাড়ি পুড়িয়ে দেন কৃষকেরা। এরপর কৃষকরা তাদের দাবীতে আরো অনড় অবস্থান নেন।

অবশেষে সরকার কৃষকদের জনদাবীর মুখে হার মানে। ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নতি স্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল। কিন্তু কৃষি আইনের সুফলের কথা কিছু কৃষককে আমরা বুঝাতে পারিনি।’

ভারতের কৃষক আন্দোলনকে জনগণের ক্ষমতা এবং ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন অনেকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, গত সাত বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যখন বিরোধীদল বিশেষ কোনও আন্দোলন খাড়া করতে পারেনি, সেখানে কৃষক সংগঠনগুলি সেটা করে দেখিয়েছে। টানা এক বছরের আন্দোলন মোদী সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছে।

সমাজবিজ্ঞানীরা এই কৃষক আন্দোলনকে বলছেন, ভারতের গণতন্ত্রের নতুন মাইলফলক। এতদিন নাগরিক সমাজের আন্দোলন বলতে বোঝাত সমাজের শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিবাদ। কিন্তু ভারত সরকারের নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে, সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবাদ।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পলিটিকাল স্টাডিজের অধ্যাপক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘নাগরিক সমাজ বলতে এত দিন শহুরে এলিট শ্রেণি বোঝাত। এখন তা আরও ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যখন দুর্বল, তখন প্রচণ্ড কেন্দ্রীভূত এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই মানুষের জোটই প্রধান বিরোধী হয়ে উঠছে। তারাই সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।’’

সুতরাং, সামগ্রিক বিচারে ভারতে এই কৃষক আন্দোলন কর্পোরেট সংস্কৃতির এই যুগে আবারো জনঅধিকারের দাবী এবং দবদবা নতুন করে চিহ্নিত করেছে। গণতন্ত্রের মানে নতুন করে হাজির করেছে, বুঝিয়ে দিয়েছে জনগণের শক্তিই আসল শক্তি।

Link copied!