যৌনতা, ধোঁকা, খুন দ্যা হাউস অব গুচির অন্তরালের সত্য

তাহির জামান প্রিয়

জানুয়ারি ২৩, ২০২৪, ০৫:৫৮ পিএম

যৌনতা, ধোঁকা, খুন দ্যা হাউস অব গুচির অন্তরালের সত্য

সংগৃহীত ছবি

If luxury had a face… Then that is Gucci

তামাম দুনিয়ায় আভিজাত্যের প্রতীক হাতে গোনা যদি কয়েকটি ব্র্যান্ড থেকে থাকে, তাদের মধ্যে গুচির নাম থাকবে সেরার তালিকায়। গুচির প্রতি ফ্যাসিনেশন কাজ করে না এমন ফ্যাশনপ্রেমী মেলা ভার। একটি ব্র্যান্ড যেখানে নির্ধারণ করে দিবে আপনার ব্যক্তিত্ব এবং ঘটাবে আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ।

আপনারা যে নিউমার্কেট থেকে গুচির ব্যাগ, স্যান্ডেল কিনে ব্যবহার করেন, এটা সেই গুচি না।
আমরা বলছি দ্য রিয়েল গুচির কথা। গুচির ব্র্যান্ড ভ্যালু সম্পর্কে জানলে চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যাবে।

গুচির ব্র্যান্ড মূল্য প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা! যা দিয়ে অনায়াসে ৭টি পদ্মা সেতু ও ৬টি মেট্রো রেল বানানো সম্ভব।

চলুন ফিরে যাই যৌনতা, ধোঁকা, খুন - দ্যা হাউস অব গুচির অন্তরালের সত্য অনুসন্ধানে…

স্বামীকে হত্যা করতে ভাড়াটে খুনি ভাড়া করেছিলেন, এবং নির্দ্বিধায় সেই হত্যাকাণ্ডের দায় অকপটে স্বীকারও করেছিলেন। বলছিলাম বিখ্যাত গুচি হত্যাকাণ্ডের গল্প। যেখানে স্ত্রী নিজের স্বামীকে হত্যার দায় স্বীকার করেছিলেন।

এই সত্য ঘটনা অবলম্বনে একটি সিনেমাও নির্মিত হয়েছে “দ্য হাউস অফ গুচি”।

বিখ্যাত মার্কিন গায়িকা ও অভিনেত্রী লেডি গাগা প্রশংসিত হয়েছেন সিনেমাটিতে অভিনয় করে।

সময়টা ১৯৯৫ সাল, মার্চের ২৭ তারিখ। 

ইতালির মিলানে বিখ্যাত ফ্যাশন জায়ান্ট মাউরিজ্জিও গুচিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সারা পৃথিবী তখন নিশ্চুপ। এত বড় ক্ষমতাশালী মাউরিজ্জিও গুচিকে কে বা কারা হত্যা করলো তা নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি, কিন্তু এই রহস্যের কোনো সুরাহা তখনো হয়নি।

হয়তো এই আলোচিত হত্যাকাণ্ড অন্তরালেই থেকে যেত।

এই ঘটনার ঠিক দুই বছর পর মাউরিজ্জিও গুচির সাবেক স্ত্রী প্যাট্রিজিয়া রেজজিয়ানিকে গুচি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। পরে তদন্তে বেড়িয়ে আসে আসল ঘটনা।

তিনি একজন ভাড়াটে খুনিকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মি. গুচিকে হত্যার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে আরও চারজনকে এই হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

১৯৭৩ সালে মাউরিজ্জিও গুচি আর প্যাট্রিজিয়া রেজজিয়ানির বিয়ে হয়। পরবর্তীতে এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, এলেসজান্দ্রা এবং এল্লেগরা।

গুচির দাদা ছিলেন গুচিও গুচি, তার হাত ধরেই জন্ম পৃথিবীর বিখ্যাত এই ফ্যাশন ব্র্যান্ডের। ১৯২১ সালে তাদের পারিবারিক চামড়ার ফ্যাক্টরি থেকেই হালের গুচির যাত্রা শুরু হয়।

গুচির তৃতীয় প্রজন্মের মাউরিজ্জিও গুচি পারিবারিক সূত্রে পরবর্তীতে গুচির কর্ণধার হয়ে উঠেন।

বিয়ের পর স্বামীর সাথে পারিবারিক এই ব্যবসায় যোগ দেন প্যাট্রিজিয়া রেজজিয়ানি, হয়ে উঠেন গুচির প্রধান পরামর্শক। এরপর স্বামী স্ত্রী দুইজন মিলেই সামলাতে থাকেন পারিবারিক ব্যবসা।

১৯৮৫ সাল, ১২ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনে কোনো কারণ ছাড়াই রেজজিয়ানিকে ডিভোর্স দিয়ে দেন মাউরিজ্জিও গুচি।

কারণ স্ত্রীর অন্তরালে আরেকটি সম্পর্ক জড়িয়ে পড়েন তিনি, পরে তার সেই নতুন প্রেমিকা পাওলা ফ্রাঞ্চির সাথেই থাকতে শুরু করেন মাউরিজ্জিও।

ঘটনার আকস্মিকতায় রাগে রেজজিয়ানি স্বামীর কাছে এর ব্যাখ্যা চান, কয়েক দফা আলোচনায় বসার চেষ্টা করেন।

১৯৯৩ সাল, মাউরিজ্জিও গুচি ব্রান্ডের ৫০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেন মাত্র ১৫০ মিলিয়ন ডলারে তাও রেজজিয়ানিকে না জানিয়েই।

এই ব্রান্ডের পেছনে রেজজিয়ানির অনেক বছরের পরিশ্রম, যখন সেটার কোনো মূল্যায়ন থাকছে না স্বভাবতই অপমানিত বোধ হবার কথা।

এই ঘটনার দুই বছর পর, মি. গুচি যখন হেঁটে কাজে যাচ্ছিলেন তাকে লক্ষ্য করে তিন তিনবার গুলি চালায় আততায়ীরা এবং ঘটনাস্থলেই সে মৃত্যুবরণ করেন।

পৃথিবীর সবচেয়ে জায়ান্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডের কর্ণধার গুচির নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে থাকে।

খুনের ঘটনায় স্ত্রী রেজজিয়ানিকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হলেও তখনও পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না।

১৯৯৭ সালে এক অজ্ঞাত সূত্রে নিজের সাবেক স্বামীকে খুনের ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।

এরপরে তিনি গ্রেপ্তার হন তার সাথে পিনা অঊরিয়েম্মা যে এই খুনের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তাকেও পুলিশ আটক করে। পিনা পেশায় ছিলেন জ্যোতিষী।

তদন্তে একে একে বেরিয়ে আসে হত্যায় সংযুক্ত প্রধান আসামি বেনেদেত্তো সিরাউলো ভাড়াটে খুনি, ওরাজিও সিসালা গেটওয়ে ড্রাইভার, ইভানো সাভিওনি যে খুনিকে ভাড়া করেন তাদের নাম।

প্যাট্রিজিয়া রেজজিয়ানি যার মাথায় তার সাবেক স্বামীকে হত্যা করার ভূত চেপে ছিল এবং সে অকপটে সবার সামনে তা স্বীকার করতেও দ্বিধা করেননি, সেই যায়গাটা পিনা আরও প্রভাবিত করে এই ঘটনা ঘটান।

পরে মাস্টারমাইন্ড পিনা প্যাট্রিজিয়াকে ব্লাকমেইলও করেন সে প্রায় ৪০ কোটি টাকা দাবি করে মুখ বন্ধ রাখার জন্য।

কিন্তু এর সাথে প্যাট্রিজিয়া গর্বে স্বীকার করেন, একটা টাকাও তার বরবাদ হয়নি। তবুও প্যাট্রিজিয়া এখানে হাতের পুতুল ছিলেন, টাকার উৎস ছিলেন।

পরবর্তীতে অবশ্য অভিযুক্ত পাঁচজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দেয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ভাড়াটে খুনি বেনেদেত্তো সিরাউলোকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়।

পিনা অউরিয়েম্মাকে ২৫ বছর এবং প্যাট্রিজিয়া রেজজিয়ানিকে ২৯ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।

২০১৬ সালে দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্যাট্রিজিয়া রেজজিয়ানি বলেন, “আমার মাউরিজ্জিওর উপর নানা ব্যাপারে অনেক রাগ ক্ষোভ ছিল কিন্তু সব কিছুর উপরে পারিবারিক ব্যাবসার এরকম ক্ষতি করাটা মেনে নিতে পারিনি। এটা অনেক বড় বোকামি, এটা নিশ্চিত ব্যর্থতা। তার এটা আমার সাথে করা উচিৎ হয়নি।”

রেজজিয়ানির আপিল করার যতোগুলো সুযোগ ছিল সবগুলোকেই খারিজ করে দেয়া হয়, জেলে শুধুমাত্র তার পোষা প্রাণী ফেরেটকে রাখার অনুমতি দেয়া হয়। ২০১৪ সালে মাত্র ১৬ বছর জেল খাটার পর সে মুক্তি পায় বিশেষ বিবেচনায়।

যখন সাংবাদিকরা তাকে গুচি হত্যার ব্যাপারে প্রশ্ন করেন তখন প্যাট্রিজিয়া গুচি বলে উঠেন, “আরেহ! আমি তো তাকে নিজ হাতে গুলি করে মারিনি। আমার চোখের লক্ষ্য খুব একটা ভালো না, তাই আমি মিস করতে চাইনি।”

২০২০ সাল, হলিউডের বিখ্যাত নির্মাতা রিডলি স্কট নিয়ে এই ঘটনা নিয়ে একটা সিনেমা নির্মাণ করতে চান, এরপর “দ্য হাউস অব গুচি” নামে সারা গে ফোরডেনের বই থেকে চিত্রনাট্য সাজানো হয়।

এই বিখ্যাত দম্পতির চরিত্রে দেখা যায় মার্কিন গায়িকা লেডি গাগা এবং স্টার ওয়ার্স অভিনেতা এডাম ড্রাইভারকে।

বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা জ্যারেট লেটো নিজেকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন মি. গুচির কাজিন হিসেবে। এখানে চরিত্রের প্রয়োজনে যেভাবে সে নিজেকে পাল্টিয়েছে, সিনেমার ইতিহাসে তা মাইলফলক হয়ে থাকবে।

গাগা যখন রেজজিয়ানির চরিত্র নিয়ে অভিনয় করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনও তার সাথে রেজজিয়ানির দেখা হয়নি।

গাগা এ বিষয়ে বলেছিলেন, আমি চাইনি সে আমাকে প্রস্তুতি নিতে দেখুক যে কিভাবে আমি তাকে ফুটিয়ে তুলবো , আমি শুধুমাত্র সত্যটাকে ফুটিয়ে তুলতে চাই। ২০২১  সালে হলিউডে বেশ আলোড়ন তুলে মুক্তি পায় সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত মুভি ‘দ্য হাউস অফ গুচি’।

Link copied!