ছবি: সংগৃহীত
গ্রিক মিথোলজির আর্তেমিস যেমন পাহাড়, জঙ্গল, অরণ্যের সন্তান—প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়া এক সাহসিনী। হাতে থাকত ধনুক-বাণ, নিখুঁত লক্ষ্যভেদ ছিল তার শক্তি। আর আজকের বাংলাদেশে, এক পাহাড়ি কন্যা, ঋতুপর্ণা চাকমা যেন সেই আধুনিক আর্তেমিস। ধনুক নয়—যার আছে বাঁ পায়ের গোলক-তীর। লক্ষ্যভেদে তিনিও তেমনি নিখুঁত, ভয়হীন, তীব্র।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলের এই উদীয়মান সূর্য একা হাতে ইতিহাস গড়েছেন। বাংলাদেশের চেয়ে র্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারের বিপক্ষে দুটি গোল দিয়ে দেশের প্রথম নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে যাত্রার দরজা খুলে দিয়েছেন যিনি।
বাঁ পায়ের জাদু
আর্তেমিস যেমন নির্ভীক শিকারি ছিলেন, ঋতুও তেমনি গোলপোস্টের দিকে দৃষ্টিপাত করা এক শিকারি। সুযোগ এলেই তিনি ছোঁড়েন বল, গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে কিংবা পায়ের পাশ ঘেঁষে। কেউ আটকাতে পারে না—সেটা মিয়ানমারই হোক, নেপালই হোক, বা ভবিষ্যতের কোনো বিশাল দল।
মিয়ানমারের বিপক্ষে ঋতুপর্ণার দুটি গোল যেন শুধু গোল নয়—এটা ছিল এক ‘ঐশ্বরিক বার্তা’। প্রথম গোলটিতে তিনি নিজেই ফ্রি–কিক নেয়া বল দেয়াল ছুঁয়ে ফিরে পেয়ে প্লেসিংয়ে বল পাঠালেন জালে। দ্বিতীয়টি যেন এক আকাশপথে ছোড়া তীর—বক্সের কোণ ঘেঁষে এমন শট, যা গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে ঢুকে গেল জালে। ইয়াঙ্গুন স্তব্ধ। পুরো স্টেডিয়ামে তখন শুধু এক নাম—ঋতুপর্ণা।
শোক, সংগ্রাম, সাহস
তবে এই জাদু হাওয়ায় আসেনি। এর পেছনে আছে ভাইকে হারানোর শোক, বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা, দারিদ্র্যের আঁধারে লুকিয়ে থাকা এক অসীম প্রতিজ্ঞা। ২৯ জুন মাঠে নামার আগে ঋতু লিখেছিলেন, “আজ তোমার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী সিজি, তোমায় অনেক ভালোবাসি।”
ঋতুর ছোট ভাই পার্বণ চাকমা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন ২০২২ সালে। ভাই পার্বণকে হারানো সেই দিনেও গোল করেছিলেন তিনি। আজও করেন, বারবার করেন—আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন বলেন, “দেখো ভাই, আমি পারছি!”
বিদ্রোহ, কিন্তু ফিরেও আসা
যে মেয়ে একদিন কোচ বাটলারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ তাকেই দলে রাখেন সেই কোচ। কেন? কারণ, তিনি জানেন—ঋতু মানেই শেষ মুহূর্তের আশা। ঋতু মানেই গোল। ঋতু মানেই ইতিহাস।
তাই তো কোচ পিটার বাটলার বাদ দেননি তাকে। যদিও গত ৩০ জানুয়ারি ১৮ জন নারী ফুটবলার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, ঋতু ছিলেন তাতে। কিন্তু দল পুনর্গঠনের সময় ঋতু, মনিকা, মারিয়া, তহুরাদের সুযোগ দেওয়া দিয়েছেন ব্রিটিশ কোচ।
বাটলার জানতেন, কার হাতে আছে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। জানতেন, কাকে তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বড় মঞ্চে আবারও সেটি মনে করিয়ে দিলেন ঋতুপর্ণা।
ঋতু, ইউ বিউটি!
ঋতু এখন কেবল একজন ফুটবলার নন। তিনি পাহাড়ি কন্যা হয়েও সমতলের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া এক নাম। তিনি মেয়েদের জন্য এক অনুপ্রেরণা, যে বলে—‘হ্যাঁ, আমরাও পারি।’ রাঙামাটির ছোট গ্রাম মগাছড়ি থেকে উঠে আসা এই মেয়ে আজ দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।
তার শট, তার গতি, তার বল নিয়ন্ত্রণ দেখে মানুষ বলে ওঠে—“ঋতু, ইউ বিউটি!” আর সেটা শুধু প্রশংসা নয়, সেটা এক স্বীকৃতি—ঋতুপর্ণা এখন বাংলাদেশের সেরা অ্যাথলেটদের একজন।
রাঙামাটির ছোট গ্রাম মগাছড়ি থেকে উঠে আসা এই মেয়েটি আজ শুধু বাংলাদেশের নারী ফুটবলের মুখ নন—তিনি লড়াই করে উঠে আসা প্রতিটি নারীর প্রতীক। দারিদ্র্য তাকে দমাতে পারেনি, বাবার ক্যানসারে মৃত্যু কিংবা ভাইয়ের শোক তাকে ভেঙে দিতে পারেনি।
তিনি গোল করেন; কারণ জীবন তাকে শিখিয়েছে, হার মানা যাবে না। তিনি ছুটে চলেন; কারণ পাহাড়ের বাতাস তাকে শিখিয়েছে, থেমে গেলে চলবে না।
আমরা জানি না, সামনে তার গন্তব্য কোথায়—ইউরোপের কোনো ক্লাব, বিশ্বকাপের আলো, নাকি আরও উঁচু এক মঞ্চ। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত, ঋতুপর্ণা যেখানে যাবেন, সেখানেই ইতিহাস লেখা হবে বাঁ পায়ের একটি শটে।