রাজধানীতে হারিয়ে যাওয়া পুকুর আখ্যান

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ৭, ২০২৩, ১২:০৫ এএম

রাজধানীতে হারিয়ে যাওয়া পুকুর আখ্যান

রাজধানীতে একের পর এক জলাশয় ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে আবাসন। প্রতি বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হোচ্ছে। আর ঢাকা ডুবে যাচ্ছে। বিষেষজ্ঞরা বলছেন, পুকুরগুলোর অর্ধেক থাকলেও ঢাকায় এত জলাবদ্ধতা হতো না। নগরবাসীর সুবিধার জন্য এসব পুকুর সংরক্ষণ বা টিকিয়ে রাখা দরকার ছিল।

সম্প্রতি একটা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল রাজধানীর বঙ্গবাজারে। বেশ কয়েকটি মার্কেট পুড়ে ছাই। ঠিক রাস্তার উল্টো দিকেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তর। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি বঙ্গবাজারের। সাড়ে ছয় ঘন্টা ফায়ার সার্ভিসের ৫০ ইউনিটের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অবশেষে আগুন নিয়ন্ত্রনে আসে।

বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে পানি সমস্যা দেখা দেয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিনও বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন। ওইদিন তিনি বলেন, “বঙ্গবাজারের আশপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর ছাড়া পানির আর কোনো উৎস ছিল না। ওসমানি উদ্যানে একটা লেক ছিল তারও এখন কোন হদিস নেই। হেলিকপ্টারে করে হাতিরঝিল থেকে পানি এনে আগুনে ছিটাতে হয়েছে।”

রাজধানীতে এক সময় বেশ কয়েকটি খাল থাকলেও গিত তিন দশকে বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে।  

বাংলাদেশে পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত সরকারি জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডাব্লিউএম) এক সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গত সাড়ে তিন দশকে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল। জলাশয় ভরাটের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালে  ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৫২ হেক্টর এবং নিম্নভূমি ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর। একই সময়ে খাল ও নদী ছিল দুই হাজার ৯০০ হেক্টর। রাজধানীর বৃষ্টির পানি এসব খাল দিয়েই পড়েছে নদীতে। ২০১৪ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৩৫ হেক্টর, নিম্নভূমি ছয় হাজার ১৯৮ হেক্টর এবং নদী-খাল এক হাজার দুই হেক্টর। অর্থাৎ ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪.৪৫ শতাংশ। এ সময়ের ব্যবধানে নিম্নভূমি কমেছে ৫৪.১৮ এবং নদী-খাল ৬৫.৪৫ শতাংশ।

মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার। ১৯৮৯ সালের দিকে সেটা কমে ১ হাজার ২শ’তে নেমে আসে। ২০০৭ সালে মৎস্য ভবন থেকে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, পুকুরের সংখ্যা মাত্র ২শ’। তবে এখন হিসাব করলে ডোবা ও পুকুরের সংখ্যা একশ’র বেশি হবে না বলে মৎস্য ভবনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এদিকে ঢাকা শহরে পুকুরের সঠিক সংখ্যার হিসাব নেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে।

হারিয়ে যাওয়া পুকুরগুলোর মধ্যে শাহবাগে বড় দুটি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে একটিতে বর্তমান আজিজ সুপার মার্কেট এবং অন্যটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজিব হল ও জিয়া হল করা হয়েছে। আজিজ সুপার মার্কেটের পশ্চিম পাশেও একটি পুকুর ছিল, যেখানে পাওয়ার হাউস করা হয়েছে।

রাজধানীর গোলাপবাগে পুকুর ছিল যা এখন ভরাট করে সিটি কপোরেশনের কোয়ার্টার বানানো হয়েছে। শহরের শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলিতেও অনেক বড় একটি পুকুর ছিল। চারদিক থেকে ভরাট করার কারণে এটা এখন ছোট ডোবায় পরিণত হয়েছে। শহরের জিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকায় প্রচুর ছোট ছোট পুকুর বা ডোবা ছিল। এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বহুতল ভবন।

এছাড়াও বাসাবো, খিলগাঁও, রাজারবাগ এলাকার প্রায় সব পুকুরই সরকারিভাবে ভরাট করা হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুর, কমলাপুর রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে রেলের ঝিল, আহমদবাগ এলাকার ঝিলের নাম মানচিত্র থেকে উঠে গেছে। রেলওয়ের ঝিল দুটিতে হাসপাতাল ও কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে। খিলগাঁওতে বিখ্যাত পুকুর হয়ে গেছে খেলার মাঠ। পুরান ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্য সিক্কাটুলী পুকুরটিও হুমকির মুখে।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ রানা আব্বাস দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেছেন, পুকুরসহ জলাশয় ভরাটের ফলে জীব বৈচিত্র্যে ব্যাঘাত ঘটছে। পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। জলাশয় কমে যাওয়ায় রাজধানীতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটলে পানিরই যোগান নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে।

জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও সেগুলো না মানায় একের পর এক ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্প। সরকার জলাধার রক্ষায় ২০০০ সালে আলাদা আইন করলেও এর কোনো সুফল নেই। অথচ এ আইনে বলা আছে, কোনো অবস্থায় খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকালেও প্রাকৃতিক জলাশয়, জলাধার, খাল-নদী ইত্যাদির স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যাবে না।

জনস্বার্থে ও একান্ত প্রয়োজন হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু জলাধার আইনের তোয়াক্কা না করেই জলাশয়গুলো দ্রুত দখল ও ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।

Link copied!