জুলাই ৪, ২০২৫, ০৫:৫৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকুবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে দুই সন্তানসহ নারীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই গ্রামে মা, ছেলেমেয়েসহ একই পরিবারের তিনজনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সামনে এনে এলাকাবাসীকে খেপিয়ে নৃশংস এ ঘটনা ঘটানো হয়। তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া থানায় মামলাও হয়নি।
মুরাদনগরের বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান শুক্রবার বেলা একটার দিকে বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তারা কুমিল্লা থেকে এজাহার লিখে এনে জমা দেবেন। ঘটনার পর এলাকা পুরুষশূন্য। সবাই পলাতক। তারা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। খবর প্রথম আলো।
ওসি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারটির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও এখন সবাই জামিনে ছিলেন। বৃহস্পতিবার যারাই নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
নিহত তিনজন হলেন কড়ইবাড়ি গ্রামের খলিলুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা বেগম ওরফে রুবি (৫৩), তার ছেলে রাসেল মিয়া (৩৫) ও মেয়ে তাসপিয়া আক্তার ওরফে জোনাকি (২৯)। এ ছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন রোকসানার আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (২৭)। গতকাল আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
মুরাদনগর-নবীনগর সড়কের কড়ইবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রোকসানাদের বাড়ি। সেখানে বাজারের মতো অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করায় আজ এলাকার বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কড়ইবাড়ি গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, গতকাল রোকসানার বাড়ির সামনে অন্তত এক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। যাদের বেশির ভাগই এলাকার যুবক শ্রেণির। এ জন্য এখন বেশির ভাগ বাড়ি পুরুষশূন্য। সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন। এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন টহল দিচ্ছেন।
‘চেয়ারম্যান-মেম্বারের ইন্ধনে’ হামলার অভিযোগ
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর ক্ষোভ ছিল। মঙ্গলবার এলাকার একটি ওষুধের দোকান থেকে স্থানীয় এক শিক্ষকের মুঠোফোন চুরি যায়। অভিযোগ ওঠে, বোরহান উদ্দিন নামের এক তরুণ মুঠোফোনটি চুরি করেছেন। বোরহান নিহত তাসপিয়ার স্বামীর সঙ্গে কাজ করেন। এ ছাড়া এলাকাবাসী তাকে রোকসানার খুচরা মাদক বিক্রেতা হিসেবে চেনেন।
মঙ্গলবার মুঠোফোন চুরির অভিযোগে বোরহানকে আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাচ্চু মিয়া ও স্থানীয় ব্যবসায়ী বাছির উদ্দিনের নেতৃত্ব মারধর করা হয়। খবর পেয়ে রোকসানা বোরহানকে তাদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে বাচ্চু ও বাছিরদের সঙ্গে কথা–কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে কড়ইবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যান স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও সদস্য বাচ্চু মিয়া। এ সময় তাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান রোকসানা বেগম ও তার মেয়েরা। একপর্যায়ে রোকসানা মুঠোফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাচ্চু মিয়াকে একটি চড় মারেন।
ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আধা ঘণ্টার মধ্যে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে বাছিরের নেতৃত্বে হামলা করে প্রথমে রোকসানার বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। একপর্যায়ে মাদক ব্যবসার বিষয়টি উসকে দিয়ে পুরো পরিবারকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান। গুরুতর আহত হন একজন। রোকসানার স্বামী ও আরেক মেয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে যান।
নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, ‘বাছির নেতৃত্ব দিয়ে পুরো হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছে। বাছিরের পরিবারের অনেক লোকজন হত্যাকাণ্ডে জড়িত। চেয়ারম্যান ও মেম্বারের ইন্ধনে বাছির নেতৃত্ব দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। চেয়ারম্যান ঘটনার আগের দিনও এসেছিলেন কড়ইবাড়ি। ঘটনার দিন সকালে তিনি এখানেই ছিলেন। চেয়ারম্যান ও মেম্বার পুরো ঘটনায় জড়িত। তারাই যুক্তি করে আমার স্বামীর পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে। আমি তাদের বিচার চাই।’
ঘটনার পর থেকেই ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া ও বাছির এলাকাছাড়া। তাদের মুঠোফোনও বন্ধ। ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি ঘটনার আগের দিন ওই এলাকায় গিয়ে কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে নিষেধ করেছিলেন বলে দাবি করেন।
শিমুল বিল্লাল বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে কড়ইবাড়ি গিয়েছিলাম একটি রাস্তার কাজের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তখন রোকসানার বাড়ির পাশে একটি দোকানে বসি। এ সময় রোকসানা ও তার মেয়েরা এসে আমার কাছে মোবাইল চুরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে থাকে। আমি রোকসানাকে বলি, তোমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। পরশু (মঙ্গলবার) তুমি ও তোমার লোকজন মেম্বারসহ কয়েকজনের গায়ে হাত তুলেছ। এর মধ্যে সেখানে আসেন বাচ্চু মেম্বার। তখন রোকসানার সঙ্গে তার (বাচ্চু) কথা-কাটাকাটি হয়। পরে আমি তাদের দুই পক্ষকে দুই দিকে সরিয়ে দিই। এরপর আমি চলে যাই। চলে আসার প্রায় ৪০ মিনিট পর এ ঘটনা শুরু হয়েছে বলে জেনেছি। আমি কখনোই আইন হাতে তুলে নেওয়ার পক্ষে না। হত্যার ঘটনায় আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, রোকসানার পরিবার প্রায় তিন দশক ধরে মাদকের কারবারে জড়িত। এলাকার এমন কোনো পরিবার নেই, যারা রোকসানার লোকজনের হাতে হয়রানির শিকার হয়নি। কিছু হলেই মামলা দিয়ে হয়রানি করত। এ জন্য এলাকার লোকজন তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। কিন্তু তিনি আইন হাতে তুলে নেওয়াকে সমর্থন করেন না। তিনি চান, যারা ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।