ছবি: সংগৃহীত
মধুর ক্যান্টিন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি জাতীয় সংকটে মধুর ক্যান্টিন ছিল ছাত্রসমাজের প্রাণকেন্দ্র। শুধু অতীতেই নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও ছাত্র আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং জাতীয় রাজনীতির পথচলায় ক্যান্টিনটি রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মধুর ক্যান্টিনকে বিবেচনা করা হয়, দেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মিলনমেলা। যেখানে ভাবনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা।
এই ক্যান্টিন থেকেই জন্ম নিয়েছে বহু ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সংগ্রামের রূপরেখা—যা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা। নানা সময়ের ইতিহাস গড়ে উঠেছে এই ক্যান্টিনকে ঘিরেই।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধুর ক্যান্টিনের সেই ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক পরিবেশে ভাটা পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এটি একচেটিয়াভাবে দখলে রেখেছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ।
টেবিলভিত্তিক মুক্ত আলোচনা, মতবিনিময়ের যে সংস্কৃতি একসময় মধুর ক্যান্টিনের বৈশিষ্ট্য ছিল, তা ক্রমেই বিলীন হয়ে যায়। ক্যান্টিনজুড়ে চলে একপাক্ষিক রাজনৈতিক কার্যক্রম, যেখানে অন্য ছাত্র সংগঠন—বিশেষ করে ছাত্রদলসহ বিরোধী মতের সংগঠনের—পক্ষে কার্যত কোনো অংশগ্রহণই সম্ভব ছিল না। কখনো কখনো বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের টেবিল তো দূরের কথা, ক্যান্টিনের ফ্লোরেও বসতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিএম কাউসার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “এক সময় এমনও হয়েছে ছাত্রলীগ মধুর ক্যান্টিনে আমাদের বসার জন্য কোন চেয়ার টেবিল দেয়নি। আমরা কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ মধুর ক্যান্টিনের ফ্লোরে বসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতাম। মধুর ক্যান্টিনের দক্ষিণ পাশের টেবিল ছিল সরকারি দলের এবং উত্তর পাশের টেবিলটি ছিল বিরোধী দলের। কিন্তু আমাদেরকে ঠিকমতো টেবিলও দেয়া হতো না। তিনটির জায়গায় একটি টেবিল দেওয়া হতো যাতে শুধুমাত্র সিনিয়র নেতা কর্মীরা বসতে পারতেন। এখন সময় পাল্টেছে। মধুর ক্যান্টিনে এখন সবাই বসেন, আড্ডা দেন। আধিপত্যবাদের যে রাজনীতি সেটি বাংলাদেশি ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেক কম।”
প্রায় একই রকম স্মৃতিচারণ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, “২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর ছাত্রলীগ পুরো মধুর ক্যান্টিন দখল করে ফেলে। পরবর্তীতে তারা সেখানে যাওয়ার মত পরিস্থিতিও রাখেনি। টেবিলগুলোতে তারা রাখে একচেটিয়া দখল।”
বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে তৎকালীন সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের মারধরও করা হয়েছে মধুর ক্যান্টিনে ঢুকলে বলে অভিযোগ আছে। তৎকালীন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মামুন খান, বর্তমান কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শাহজাহান শাওনসহ মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়েছেন অনেক নেতা কর্মীরা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ১৩ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত অবস্থায় ছিল ছাত্রদল।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্ম “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন”-এর সম্মুখসারির সমন্বয়কদের সংগঠন ছাত্রশক্তিকে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ আছে।
বিলুপ্ত হওয়া সংগঠন ‘ছাত্রশক্তি’র নেতাদের অভিযোগ, ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত অবস্থান নেয় মধুর ক্যান্টিনে। মধুর ক্যান্টিনে জায়গা না পেয়ে ডাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করতে বাধ্য হয় সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট।
দীর্ঘদিন মধুর ক্যান্টিনে একচেটিয়া দখলদারিত্ব কায়েমকারী ছাত্রলীগ আজ পলাতক। সেই নিয়ন্ত্রিত ক্যান্টিনে এখন ফিরেছে প্রাণ। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর যাতায়াত বেড়েছে অনেকগুণ। নিয়মিত হচ্ছে সংবাদ সম্মেলন, বসছে রাজনৈতিক আড্ডা। সহাবস্থান ফিরে এসেছে—একটি দল বা মত নয়, এখন মধুর ক্যান্টিনে চোখে পড়ে ছাত্র রাজনীতির বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি।
টেবিল ভাগ করে নেওয়ার পুরনো ঐতিহ্য ফিরেনি ঠিকই, তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও সহাবস্থান স্পষ্ট। বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)সহ আটটি ছাত্র সংগঠনের প্রধান কার্যালয় গড়ে উঠেছে মধুর ক্যান্টিনকে ঘিরে। প্রতিদিন বাড়ছে মানুষের উপস্থিতি। এক সময়ের দখলদারিত্ব ও দমন-পীড়নের সেই ছায়া আর নেই।
মধুর ক্যান্টিনের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসেরই প্রতিচ্ছবি।
১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে ’৫২-এর শহীদ স্মৃতি, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান—সব কিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই ক্যান্টিনের নাম। এখানে ভিড় করতেন ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা, উঠতি কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী-সাংবাদিক, এমনকি খেলোয়াড়রাও। কেউ দাম দিতেন, কেউ বলতেন লিখে রাখো—আর মধুদার সেই বিখ্যাত খাতার শিরোনাম ছিল ‘না দিয়া উধাও’।
সে খাতায় স্থান পেয়েছিলেন আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজ, শামসুর রহমান, আহমদ ফজলুর রহমানসহ বহু কৃতী ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে অনেকেই ‘না দিয়া উধাও’ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন।
১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত অবস্থায় মধুদাকে মাটিচাপা দেওয়া হয় জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে, শহীদদের সঙ্গে। স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি তাঁর সন্তান অরুণ দে আবার চালু করেন মধুর ক্যান্টিন।
আজও সেই ক্যান্টিন টিকে আছে—বেঁচে আছে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়।