বিবিসির প্রতিবেদন

ত্রাণ সংস্থার ঠিকাদাররাও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের গুলি করেছে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ৪, ২০২৫, ১২:৫৭ পিএম

ত্রাণ সংস্থার ঠিকাদাররাও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের গুলি করেছে

ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত মানবিক সংগঠন গাজা হিউম্যানিটিরিয়ান ফাউন্ডেশনকে (জিএইচএফ) নিয়ে বিতর্ক দিনে দিনে বাড়ছেই। সংস্থাটির ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে কীভাবে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হয়, তা নিয়ে মুখ খুলেছেন সংস্থাটির সাবেক এক নিরাপত্তা ঠিকাদার। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে তিনি জানান, কোনো কারণ ছাড়াই ত্রাণ নিতে আসা অভুক্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায় ইসরায়েলি সেনারা।

উদাহরণ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। জানান, শুধু ত্রাণকেন্দ্র ছাড়তে দেরি হচ্ছিল বলে একদল নারী, শিশু আর বৃদ্ধের ওপর মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে ইসরায়েলি সেনারা। তিনি বলেন, ‘যখন নারী-শিশু-বৃদ্ধদের ওপর গুলি চালানো হলো, তখন সেখানে থাকা আরেকজন ঠিকাদার, যিনি বের হওয়ার পথের ওপরে একটি উঁচু মাটির বাঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি ভিড়ের দিকে টানা ১৫ থেকে ২০ রাউন্ড গুলি চালান। একজন ফিলিস্তিনি পুরুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন ঠিকাদার বলল, দারুণ! মনে হচ্ছে তুমি একটা স্কোর করেছ! এরপর তারা এ ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ঠিকাদার বিবিসিকে বলেন, তিনি জিএইচএফ কর্তৃপক্ষের কাছে ঘটনাটি নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা এটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তাদের ভাষ্য ছিলহয়তো ফিলিস্তিনি ওই লোকটি অসাবধানতাবশত পড়ে গেছে, অথবা দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। বিবিসি এ বিষয়ে জিএইচএফের কাছে জানতে চাইলে তারা তা পুরোপুরি অস্বীকার করে। তাদের দাবিজিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে কখনো বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেনি।

চলতি বছরের মে মাসে গাজায় কার্যক্রম শুরু করে বিতর্কিত এই মানবিক সংগঠন। মূলত দক্ষিণ এবং মধ্য গাজায় একাধিক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র থেকে ত্রাণ বিতরণ করে তারা। তবে, শুরু থেকেই ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটিকে গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার একটি কৌশল বলে অভিহিত করেছে। তাদের অভিযোগখাবারের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিদিন শত শত ফিলিস্তিনিকে ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিচ্ছে এই সংগঠন।

গত মে থেকে এখন পর্যন্ত জিএইচএফের ত্রাণ নিতে গিয়ে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের নির্বিচার গুলিতে নিহত হয়েছেন চার শতাধিক ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলের সাফাইতারা কেবল ‘হুমকি’ হতে পারে এমন মানুষের ওপরই হামলা চালায়। হামাসের হাতে যাতে ত্রাণ না পৌঁছায় সে জন্যই জিএইচএফের কার্যক্রম এমন কঠোর নজরদারিতে থাকে বলে দাবি ইসরায়েলের।

খোদ ত্রাণ সংস্থার নিরাপত্তাকর্মীর গুলিতে ফিলিস্তিনি নিহতের বিষয়ে জিএইচএফের দাবি, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো তুলছেন, তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে তিনি এসব মিথ্যা বলে বেড়াচ্ছেন। যদিও ওই সাবেক ঠিকাদার বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন, তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি, বরং তিনি নিজেই চাকরি ছেড়েছেন।

জিএইএফের চারটি বিতরণ কেন্দ্রেই কাজ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, সবগুলো বিতরণ কেন্দ্রেই দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজ করছে, নেই কোনো সুষ্ঠু নিয়মকানুন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ঠিকাদারদের কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা বা মানসম্মত কর্মপদ্ধতি দেওয়া হয়নি। বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা তাঁদের বলেছিলেন, ‘হুমকি মনে হলেই নির্দয়ভাবে গুলি চালাবে, পরে ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে।’

তিনি বলেন, ‘কোম্পানির ভেতরের মানসিকতা এমন ছিল যে, আমরা গাজায় যাচ্ছি। সুতরাং কোনো নিয়ম নেই, যার যা খুশি করো। কিন্তু কোনো বেসামরিক ফিলিস্তিনি হুমকিস্বরূপ আচরণ না করা সত্ত্বেও গুলি চালানোর অর্থ ফৌজদারি অপরাধ করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি সাইটে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়। সব প্রমাণ থাকার পরও জিএইচএফ বলছে, সেখানে কোনো বেসামরিককে কখনো গুলি করা হয়নি। এটা একটা নির্লজ্জ মিথ্যা ছাড়া আর কী?’

চলতি সপ্তাহে ১৭০টির বেশি দাতব্য সংস্থা ও এনজিও জিএইচএফের কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছে। অক্সফাম ও সেভ দ্য চিলড্রেনসহ এসব সংগঠন বলছে, ইসরায়েলি বাহিনী ও সশস্ত্র দলগুলো নিয়মিতভাবে ত্রাণ চাইতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায়। তবে ইসরায়েলের দাবি, তাদের সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণ নিতে আসা লোকজনের ওপর গুলি চালায় না।

তারা আরও দাবি করেছে, জিএইচএফ পাঁচ সপ্তাহে ৫ কোটি ২০ লাখ খাবার বিতরণ করেছে। অন্য সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে জিএইচএফ বলেছে, তারা কঠোর বলেই তাদের ত্রাণ দুস্থদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। আর অন্য সংস্থাগুলোর ত্রাণ লুট হয়ে যায়, তারা শুধু সেটি চেয়ে চেয়ে দেখে!

Link copied!