‘কমলাপুরের কুলিরাও আপনাদের মতো ভাষা ব্যবহার করে না’

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ২৩, ২০২৩, ০৯:০৪ পিএম

‘কমলাপুরের কুলিরাও আপনাদের মতো ভাষা ব্যবহার করে না’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ বেগম শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়ার ঘটনায় আদালতের তলবে হাজির হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২১ আইনজীবী। উপস্থিত আইনজীবী নেতাদের আদালত বলেন, সারা দেশের আইনজীবীদের প্রতি হাইকোর্টের মেসেজ- আদালত অবমাননা করলে, বিচারকদের সঙ্গে অসদাচারণ করলে- কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আইনজীবীদের সনদ আজীবনের জন্য বাতিল করতে পারি। আবার নমনীয়ও হতে পারি। এটাই আমাদের মেসেজ।

সোমবার (২৩ জানুয়ারি) বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। 

তলব করা আইনজীবীরা হলেন- অ্যাডভোকেট মো. মফিজুর রহমান বাবুল, অ্যাডভোকেট মিনহাজুল ইসলাম, এমদাদুল হক হাদি, নিজামুদ্দিন খান রানা, আনিছুর রহমান মঞ্জু, মো. জুম্মন চৌধুরী, রাশেদ মিয়া হাজারী, জাহের আলী, মো. আ. আজিজ খান, দেওয়ান ইফতেখার রেজা রাসেল, মো. ছদর উদ্দিন, মাহমুদুর রহমান রনি, মো. মাহবুবুর রহমান, মো. আরিফুল হক মাসুদ, মীর মোহাম্মদ রাইসুল আহম্মেদ, মহিবুর রহমান, মো. জাকারিয়া আহমেদ, মো. মোবারক উল্লা, মো. ফারুক আহমেদ, সফিক আহমেদ ও ইকবাল হোসেন।

শুনানির শুরুতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুটি ঘটনায় জারি করা রুলের বিষয়ে একসাথে শুনানি করতে চেয়ে সময় প্রার্থনা করেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির। তখন হাইকোর্ট বলেন, দুটো ঘটনা তো আলাদা। ওটা (আদালতের ভেতরের ঘটনা) ছিল বেয়াদবি। আজকে যারা হাজির হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিন্ন। তারা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেছেন।

এ সময় আদালত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিক্ষানবিশ দুই আইনজীবীকে সামনে ডেকে পরিচয় জানতে চান। তারা নিচুস্বরে উত্তর দিলে হাইকোর্ট বলেন, এখন এত নিচুস্বরে কথা বলছেন। বিচারকের বিরুদ্ধে স্লোগান তো উঁচুস্বরে দিয়েছেন। অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেছেন। মেট্রিক পাশ মানুষও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে না। এমনকি কমলাপুরের কুলিরাও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে না। কোনো রাজনৈতিক দলের ভাষাও এরকম হতে পারে না।

এ সময় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল, বার কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাইলে হাইকোর্ট বলেন, যারা আদালত অবমাননা করে, আদালতের সাথে অশ্লীল আচরণ করে- আপনারা যখন তাদের পক্ষে আসেন তখন আমরা লজ্জিত হই।

এ সময় বার সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল বলেন, সেদিনের প্রকৃত ঘটনা কী ছিল আমরা ব্যাখ্যায় আদালতের কাছে সব তুলে ধরব। তখন হাইকোর্ট বলেন, আপনারা কী কনটেস্ট করতে চাইছেন?

এ সময় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, জুডিশিয়ারি আমাদের সবার। জুডিশিয়ারির মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের সবার। হাইকোর্ট বলেন, সুপ্রিমকোর্ট বিচার বিভাগের অভিভাবক। আইনজীবীদেরও অভিভাবক। আপনাদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্বও আমাদের। এ সময় হাইকোর্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতের অবস্থা জানতে চান।

তখন আইনজীবী নেতারা বলেন, এখন আদালত ভালোভাবে চলছে। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাব। সবার সাথে কথা বলে সম্মানজনক সমাধানের চেষ্টা করব।

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারকের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার ঘটনায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তিনি সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতির সাথে একমত হয়ে বলেন, এ মামলায়ও সময় দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করব। প্রয়োজনে সবাই আমরা যেয়ে সবার সাথে বসব।

এ সময় আদালত ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার সেক্রেটারিকে দেখতে চান। তিনি ডায়াসের সামনে এলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ঘটনার দিন বার সম্পাদক ছিলেন না। তখন আদালত বলেন, কে কোথায় ছিলেন সব আমরা খুঁজে বের করব। প্রয়োজনে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেব। আদালত বলেন, সমস্যা সমাধানে যত দেরি হবে তাতে সবার ক্ষতি হবে।

হাইকোর্ট আইনজীবী নেতাদের উদ্দেশে বলেন, মেসেজ জানিয়ে দেবেন আমরা যেতে চাইলে অনেক দূর যেতে পারি। আমরা কিন্তু আইনজীবীদের সনদ আজীবনের জন্য বাতিল করতে পারি। আদালত অবমাননা তো আছেই। আবার নমনীয়ও হতে পারি। এটাই আমাদের মেসেজ।

পরে আদালত সময় আবেদন গ্রহণ করে এই মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করেন।

আদালতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন- সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, বার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল, বার কাউন্সিলের সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা, অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু, অ্যাডভোকেট বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় উপস্থিত ছিলেন।

জেলা জজ আদালতে এজলাস চলার সময় বিচারকের নামে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, বিচার বিঘ্নিত করা এবং বিচারকের মানহানি করার বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করে প্রধান বিচারপতির কাছে গত ৯ জানুয়ারি আবেদন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ বেগম শারমিন নিগার।

আবেদনপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, গত ২ জানুয়ারি এজলাস চলার সময় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারক মোহাম্মদ ফারুককে অশালীন ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এজলাস থেকে নামতে বাধ্য করার প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিমকোর্টের কনটেম্পট ব্যাচ রুল জারি করেন। এরপর অভিযুক্ত আইনজীবীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গত ৫ জানুয়ারি এবং ৮ জানুয়ারি এজলাস চলাকালে বিচারকের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেন। প্রধান বিচারপতি জেলা জজের এ আবেদনপত্র হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন।

Link copied!