আন্দোলন, অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভের লড়াই- যেকোনও মুহূর্তেই পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারে সহিংস। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছুই নেই। যখন কোনও দাবি নিয়ে কোনও গোষ্ঠী একত্রিত হয় এবং সেই দাবি বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে, বেশির ভাগ সময়ই সেই আন্দোলন হয়ে ওঠে সহিংস। স্বাধীনতাউত্তর রাজনীতিতে এদেশে অসংখ্যবার সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে। হয়েছে গণঅভ্যুত্থানও। ১৯৮৭-৯০’র এরশাদশাহীর পতনের আন্দোলন, ১৯৯৪-৯৫’র তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে তদানীন্তন বিরোধী দলের আন্দোলন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের গণআন্দোলন- সহিংসতায় রূপ নিতে বেশি দেরি করেনি।
বেঁধে দেওয়া সময়সূচির কারণে সহিংস পরিস্থিতিতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিসে যেতে হয় অনেককেই। আর দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিককে তো একেবারে ফ্রন্টলাইনে (সম্মুখসমরে) থাকতে হয়। নিরাপত্তার জন্য সাধারণ নাগরিক এবং সাংবাদিক- কিছু নির্দেশনা মেনে চলা উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। বিশেষ করে যারা ফিল্ড রিপোর্টিং করে থাকেন, তাদের জন্য এটা জানা তো খুব জরুরি।
‘সাংবাদিকতায় নিরাপত্তা ও সুরক্ষা’ নামক নির্দেশিকা অনুযায়ী সহিংস পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের অবশ্যই বিশেষ কিছু নির্দেশনা মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার আগে সেই জায়গার পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া, যথাসম্ভব উঁচু জায়গায় অবস্থান নেওয়া, হামলার শিকার হলে হামলাকারীর শরীরী ভাষা বুঝে ওঠা এবং উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগসহ আরও বিভিন্ন। এ ছাড়া সাধারণ নাগরিক হিসেবে আপনিও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন বেকায়দায়। জীবনের ঝুঁকি এড়াতে সহিংস পরিস্থিতিতে তখন আপনার করণীয় কি হতে পারে- সেটা নিয়েই আজকের আয়োজন। চলতি পথে প্রাণশঙ্কাময় বিপদ এড়াতে চলুন জেনে নেওয়া যাক-
মনে করুন, অফিসে যাওয়া কিংবা ফেরার পথে আপনার ওপর হামলা করেছে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা। তখন কি করবেন? ভয় না পেয়ে মনে সাহস ধরে রাখুন। এলাকার অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করুন এবং যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করে রাখুন, যেন দুর্বৃত্তরা আপনার কোনও ক্ষতি করতে না পারে।
সহিংস পরিস্থিতি নিজেকে বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখতে আরও একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আপনার যেসব কাজ করা জরুরি সেসব কাজ হলো-
আরও পড়ুন: কোটা পুনর্বহালের আন্দোলন: ৫৬ শতাংশ কোটায় কারা চাকরি পান?
রাজনৈতিক সমাবেশের ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিক অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে পুলিশের চোখে অনেকে আবার সন্দেহভাজন হিসেবেও শনাক্ত হন। দাবি আদায় বা রাজনৈতিক আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্যে পড়ে গেলে শান্ত হোন এবং পরিস্থিতি অনুধাবন করুন।
কোনওভাবেই সন্দেহজনক আচরণ করবেন না। এতে পুলিশ আপনাকেও আন্দোলনকারীদের একজন ভেবে আটক করতে পারে (এভাবে বহু সহজ-সরল লোক সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হন)। আবার আন্দোলনকারীদের সেন্টিমেন্টেও আঘাত দিয়ে কটূক্তি করবেন না। কেননা এই ধরনের কটূক্তি করার ফলে আপনার মানসম্মান হারানোর সমূহসম্ভাবনা আছে। গণধোলাইও খেতে পারেন।
বিরোধী আন্দোলনে হঠাৎ করে সহিংস পরিস্থিতি দেখা দিলে বেশির ভাগ পথচারীই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অনেকে আবার প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। শারীরীকভাবে যার বিভিন্ন উপসর্গ যেমন বমি করা, অজ্ঞান হয়ে পড়া প্রভৃতি দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা মাথায় চোখ-কান খোলা রাখুন। তারপর সেই অনুযায়ী আপনিও আপনার কর্মপন্থা নির্ধারণ করুন। মনে রাখবেন, আন্দোলন বা কোনও মতাদর্শ নিয়ে এ সময় কারও সঙ্গে তর্কবিতর্ক করতে যাবেন না। অস্থির সময়ে নিজের জীবনের সুরক্ষা যেখানে পাবেন, সেখানেই আশ্রয় নেবেন।
আন্দোলনের পরিস্থিতি সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এমতাবস্থায় আপনি কোনও কারণে সহিংস হয়ে ওঠা এলাকায় আছেন। এ-অবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশের সাহায্য নিন। পুলিশের সাহায্যেই আপনি নিজের সুরক্ষা পাবেন।
দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অশান্ত পরিস্থিতিতেও ফ্রন্ট লাইনে বা সম্মুখ সারিতে কাজ করে থাকেন। বিরোধী রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা ফোরামের দাবি আদায়ের আন্দোলনে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠলে সাংবাদিককে মাথা গরম না করে বেশ কিছু কাজ করতে হয়।
এ ছাড়া অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার আগেও সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে একটু ঝালিয়ে নেওয়া জরুরি। সেখানে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মারমুখী মনোভাব সম্পর্কেও বিস্তর পড়াশুনা করে নিতে হবে। বিশেষ করে কোনও বিশেষ মতাদর্শিক দলের মনোবৈজ্ঞানিক অবস্থাও এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভাবতে হবে। আরও যেসব কাজ করতে হবে, সেসব হলো-
যখন আপনার প্রধান প্রতিবেদক আপনাকে কোনও সহিংস ঘটনার রিপোর্ট কাভারেজের জন্য আপনাকে মনোনীত বা অ্যাসাইন করেন, তখন আগে থেকেই হোমওয়ার্ক করে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রকৃত অর্থেই সেখানকার পরিস্থিতি কি রকম- সেটা নিয়ে বিস্তর খোঁজখবর নিন। প্রয়োজনে থানায় ফোন করে খবর নিন। কাভারেজের আগে পরিস্থিতির খবরাখবর সংগ্রহ করলে আপনার প্রতিবেদনও শক্তিশালী হবে। আবার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থাকতে পারবেন। মনে রাখবেন, সতর্কতা হিসেবে মাথায় হেলমেট এবং গায়ে বর্ম পরে নেবেন।
সমাবেশ চলছে, আছে উত্তেজনাও। হঠাৎ পুলিশের লাঠিচার্জে সব ছত্রভঙ্গ হওয়ার উপক্রম- এর মধ্যে যদি আপনি পড়ে যান, তাহলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে দায়িত্ব পালন করতে থাকুন। কোনও অবস্থাতেই মাথা গরম করবেন না। হামলার শিকার হলে হামলাকারীর শরীরী ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন এবং উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করুন। হামলাকারীর সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হতে যাবেন না। পরিস্থিতির সুযোগও নিতে যাবেন না।
সাংবাদিক হিসেবে বিক্ষোভকারীদের মনের অবস্থার দিকে গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি। বিক্ষোভকারীরা কেন সহিংস হয়ে উঠছে, তারা কেন এত মারমুখী- সেটাও খুঁজে বের করুন। সহিংস পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হলে শান্ত থাকুন। অন্যদের সহযোগিতা নিন।
আন্দোলন, বিক্ষোভ বা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে অনেক গুজব আসতে থাকে। তাই কোনও উড়ো খবর কানে এলে সেটা ভালোভাবে ঝালিয়ে নিন। সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলুন। অফিসেও যোগাযোগ করুন। কারণ ভুলবশত আপনার কোনও একটি গুজব বা ভুল তথ্যের জন্য বড়সড় হাঙ্গামা বেঁধে যেতে পারে। সেজন্য আবারও বলছি, গুজবে কর্ণপাত করবেন না।