গ্রাম বাংলার অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবার-বাড়িগুলোতে একসময়ের আভিজাত্যের প্রতীক ছিলো কাচারিঘর। বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, বাড়ির যুবক, ছেলে, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার এ ঘরটি কাচারি ঘর বা বাংলাঘর নামে সমধিক পরিচিত ছিলো।
কালের বিবর্তনে বরগুনাসহ উপকূলের গ্রামাঞ্চলের সেই কাচারিঘর মুষ্টিমেয় কিছু বাড়িতে এখনও টিকে থাকলেও নেই তার জৌলুস বা ব্যবহার। অধিকাংশ পরিবারই একক বা যৌথ কাচারিঘর তৈরির প্রথা বাদ দিয়ে এখন ছোট পরিসরের ড্রয়িংরুমের দিকে ঝুঁকেছেন।
বর্তমান সময়ে ড্রয়িংরুমের সাজ-সজ্জার মাধ্যমে কোনো অভিজাত পরিবারের আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঝাড়বাতি, সোফাসেট, অ্যাকিউরিয়াম, ইন্টেরিয়র, রুচি অনুযায়ী কোনো ছবি দিয়ে মনোমুগ্ধকর করে সাজানো হয় ড্রইংরুম বা অতিথিশালা।
কাচারিঘরের ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয় বরগুনার আমতলী উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা পাশা তালুকদারের সাথে। জাতীর এ বীরযোদ্ধা জানান, ‘এক সময়ে একক বা যৌথ গৃহস্থ বাড়ির আভিজাত্যের প্রতীকই ছিল বাড়ির বাহির আঙিনার বৈঠকখানা। এ কাচারি ঘরের চৌকির ওপর থাকত বাড়ির অবিবাহিত ছেলে বা ছাত্ররা। আর মেহমান বা অতিথিরা এলে চৌকির ওপরে থাকতে দেয়া হতো।‘
‘মাটিতে একঢালা হোগল পাতার বা বাঁশের চাটাইয়ের বিছানা করে থাকতো বারোমাসি কামলা (শ্রমিক) ও রাখালরা। গড়গড় শব্দে তারা হুক্কা টানত আর ধোঁয়া ছাড়তো। প্রতি রাতেই পাড়ার সব কামলা/রাখাল বড় কোনো কাচারিঘরে মিলিত হয়ে গানের আসর বসাতো। চলতো পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, রূপবান,গুনাই বিবি, আলোমতি, সাগরভাসা, বেহুলা লখিন্দরের পালা। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত বসত শালিস বৈঠক। গৃহ অভ্যন্তরে যারা থাকতেন চা আর পানের ফরমায়েশ রক্ষা করতে তাদের চোখেও ঘুম ছিলো না।‘
“প্রায় প্রতিটি রাতে কাচারি ঘরওয়ালা বাড়িতে আসত অনাত্মীয়- অচেনা কোনো মুসাফির। ভেতর বাড়ি থেকে শোনা যেত কোনো অচেনা মুসাফিরদের কণ্ঠ, ‘বাড়িতে কেউ আছেন? থাকবার জায়গা হইবে। অনেক রাত হইছে, নদী পার হওন যাইবো না।”
নদীমাতৃক বাংলাদেশে এ নদীর কারণেই বাঙালিরা হয়তো অতিথিপরায়ণ হয়ে উঠেছিলো। যেমন আরবের মানুষ অতিথিপরায়ণ হয়েছিলো শুধু মরুভূমির জন্যে। যত রাতেই আসুক, অতিথিদের না খেয়ে শুতে দিত না বাড়িওয়ালারা। আবার এ সব অতিথিরা ভোররাতের অন্ধকার থাকতেই উঠে চলে যেত, এদের কারণে বাড়ির কোনো কিছু খোয়া যায়নি কোনো দিন।
আমতলীয় চাওড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান বাদল খান জানান, ‘কাচারিঘরের সামনের অংশে থাকতো বারান্দা। বারান্দায় সব সময় একটি হেলনা বেঞ্চ থাকত। ক্লান্ত পথিকরা এখানে বসে একটু জিড়িয়ে নিত। কখনো কখনো পান-তামাক (হুক্কা) খেয়ে ক্লান্তির অবসাদ দূর করতো। বারান্দার একপ্রান্তে ছোট কক্ষে থাকতেন বাড়ি লাগোয়া মসজিদের মৌলভী বা মক্তবের শিক্ষক।’
আমতলী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখন অধিকাংশ বাড়িতেই আর কাচারিঘর নেই। যে কয়টি আছে তা ব্যবহৃত না হওয়ায় অবহেলা, অযত্নে ধ্বংস প্রায়। গ্রামে আর বারোমাসি রাখালের প্রচলন নেই, নেই রাখালি গান। বাড়ির ছেলেদেরও রাতে ঘরের বাইরে থাকার অনুমতি নেই। অবকাঠামো ও যোগাযোগের উন্নতির ফলে মাঠে ঘাটে যারা কাজ করে তারা দিন শেষে নিজ বাড়িতে চলে যায়।
সময়ের বিবর্তনে শহরের পাশাপাশি গ্রামের পরিবারগুলোও ছোট ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। তাই বিলুপ্তির পথে শতবর্ষের ঐতিহ্য কাচারিঘর নামে খ্যাত বাহির বাড়ির বাংলো ঘরটি।
সূত্র বাসস