নাম তার ইশরাত রফিক ঈশিতা। পেশায় চিকিৎসক। চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ; চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন। চিকিৎসা শাস্ত্রকে আশ্রয় করে তার অভিনব প্রতারণার জাল দেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃত।
আজ পহেলা আগস্ট (রবিবার) দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার ভূয়া প্রতিনিধি পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে তথাকথিত তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক ইশরাত রফিক ঈশিতা (আইপিসি) কে সহযোগী মোঃ শহীদুল ইসলাম দিদারসহ গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪। র্যাবের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে ভিন্নধর্মী প্রতারণার তথ্য পেয়ে রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন মিরপুর-১ থেকে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-৪ যৌথ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ প্রতারণা সরঞ্জাম ও মাদকসহ গ্রেফতার করেছে এই প্রতারণার মাস্টারমাইন্ডকে। উক্ত অভিযানে ভূয়া আইডি কার্ড, ভূয়া ভিজিটিং কার্ড, ভূয়া সীল, ভূয়া সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০পিছ ইয়াবা, ০৫ বোতল বিদেশী মদ এবং মোবাইল উদ্ধার করা হয়। র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তার চাঞ্চল্যকর প্রতারণার ফিরিস্তি।
প্রতারণার কৌশল
ভূয়া নথিপত্র বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাতেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিতেন এই অভিনব প্রতারক। প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আইপি চ্যানেল ব্যবহার করতেন ইশরাত। উক্ত প্রচারণার মাধ্যমে তিনি বিশিষ্ট আলোচক সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশোতে অংশগ্রহণ করতেন। ক্ষেত্র বিশেষে গণমাধ্যমে তার টকশো, আলোচনা, সাক্ষাতকার ও সাফল্য সমূহ প্রচারিত হয়েছে। মূলত তিনি তার ভূয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সকলকে বিভ্রান্ত করতেন। তার ভূয়া বিশেষজ্ঞ ডিগ্রীগুলো যথাক্রমে-এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি তারসাথে নিজেকে বিশিষ্ট আলোচক, ডিপ্লোম্যাট, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন। এছাড়া ভুয়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে জাহির করে অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা এডিটের মাধ্যমে বিভিন্ন সাইটে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল বা থিসিস পেপার প্রকাশনায় সিদ্ধহস্ত ছিল ইশরাত রফিক।
ব্যক্তিগত পরিচয়
গ্রেফতারকৃত প্রতারক চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা থাকতেন রাজধানীর কাফরুল এলাকায় তার পিতা- খন্দকার রফিকুল ইসলাম এবং তার সহযোগী মোঃ শহিদুল ইসলাম ওরফে দিদার রাজধানীর দোহারে থাকতেন তার পিতা- মোঃ হুমায়ূন কবীর।
প্রতারণায় হাতেখড়ি
ইশরাত রফিক ইশিতা ময়মনসিংহে অবস্থিত একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হতে ২০১৩ সালে (সেশন ২০০৫-২০০৬) এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। অতঃপর জুন ২০১৪ সালের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৪ সালে একটি সরকারী সংস্থায় চুক্তি ভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে ০৪ মাস চাকুরী করার পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকুরীচ্যুত হন তিনি।
প্রতারণার বিস্তার
প্রতারণার মাধ্যমে ভূয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানীতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশগ্রহণ করেন ইশরাত রফিক। ʺYoung World Leaders for Humanityʺ নামে একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনার করতেন ইশিতা। আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের বা জনমনে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে এমন ব্যক্তিদের ছবি যুক্ত করে এ্যাডভাইজর, ভাইস চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানা পদে যোগদান করেছেন বলে ভূয়া প্রচারণা চালাতেন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে রাজধানীর একটি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠানের এই সংগঠনের মাধ্যমে ৩০ জন বাংলাদেশীকেও ʺYoung World Leaders for Humanityʺ এর সম্মাননা দেয় এই প্রতারণাকারী।
২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডবিউ ২০২০) অর্জন করেছেন বলে তিনি প্রচার চালান। এই পুরষ্কারটি ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে “বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী” পুরস্কার হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০, থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটষ্ট্যান্ডিং সায়েন্টিষ্ট এন্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড তার ভূয়া প্রতারণার সাক্ষ্য হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদে সামনে আসে।
ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরী করে ইতোমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানান তিনি। এছাড়াও উক্ত দেশগুলোকে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করা হয়ে থাকে যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভূয়া অ্যাওয়ার্ড বিতরণের বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী গ্রহণ করতেন। ইতিমধ্যে বুরুন্ডি ও আফগানিস্তানে এ ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে বলে তিনি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
প্রতারক ইশরাত রফিক প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র্যাংক ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। এই প্রতারক ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট (IPC.Phil.com) হতে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় “বিগ্রেডিয়ার জেনারেল” পদটি কিনে নেন। এছাড়া তিনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সদস্য পদের ভূয়া সনদ তৈরী করে প্রচারণা চালিয়ে যান।
বেরিয়ে আসুক থলের বিড়াল
এই অভিযান সম্পর্কে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার তথ্যমতে গ্রেফতারকৃতরা যোগসাজশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভূয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে/বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রয়েছে। তাদের আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। বর্ণিত বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।