করোনা পরিস্থিতির পর চাকরীতে অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগের ঝুঁকি, শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তাসহ নানা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষিতে নিজের জমানো টাকা রাখার নিরাপদ স্থান হয় ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে। কিন্তু সম্প্রতি তারল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকে আমানতের সুদহার ২ শতাংশ কমে গেছে। শেষ পর্যন্ত একমাত্র ভরসা সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত বসাল সরকার। যার ফলে এখন ব্যাংক বহির্ভূত সোয়া দুই লাখ কোটি টাকার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে।
ব্যাংকের বাইরে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাস শেষে ব্যাংক খাতের বাইরে তথা মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৭ হাজার ৪২ কোটি। জুন মাসেও মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৫১৭ কোটি। এক মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি। এ টাকার একটি অংশই ঘুরেফিরে সঞ্চয় হিসেবে আবারও ব্যাংকে ফেরার কথা। কিন্তু সুদের হার কমিয়ে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন পরামর্শের পর কমল মুনাফা
অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন থেকেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সঞ্চয়পত্র সব শ্রেণির মানুষের কাছে বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় আর্থিক পণ্য। সে জন্য মুনাফায় হাত দেওয়ার আগে সঞ্চয়পত্রের কেনাবেচার ক্ষেত্রে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়। পাশাপাশি অনলাইন ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে। আবার একক ও যৌথ নামে সর্বোচ্চ কত টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে, তারও সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর এসে কমানো হলো মুনাফার হার।
ব্যাংক খাতের আমানতে আগ্রহ কমেছে
এর আগে গত বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে বেধে দেওয়া হয়। তার ধাক্কা এসে লাগে আমানতের সুদহারেও। কমতে কমতে গত জুলাই শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার নেমে আসে ৪ শতাংশে। এটিও গড় সুদহার। কোনো কোনো ব্যাংকে আমানতের সুদহার ২ শতাংশে নেমে গেছে। অন্যদিকে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকে টাকা রেখে সাধারণ মানুষ আসলে কোনো মুনাফা পান না। বরং টাকার মান কমে। এ অবস্থায় গত আগস্টে ব্যাংকের আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির ওপরে রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
শেয়ারবাজার চাঙ্গার সম্ভাবনা
ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের বাইরে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের আরেকটি মাধ্যম শেয়ারবাজার। ব্যাংকে সুদ যখন কমে যায়, সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমানোর ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ তসলিম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রই মানুষের সবচেয়ে ভরসার স্থান। শেয়ারবাজারে সবাই বিনিয়োগ করতে পারে না। এছাড়া এখানে বিনিয়োগ ঝুঁকিও রয়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষকে এক ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। যেটা ভবিষৎ অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়।
তিনি আরও বলেন, সঠিক অবস্থানে সঞ্চয়ের উপায় না থাকায় বিভিন্ন ই কমার্সে প্রলুব্ধ হচ্ছে জনগণ। তাই এই মুহুর্তে মুনাফা কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
কোন সঞ্চয়পত্রে কত কমানো হয়েছে?
দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পারিবারিক সঞ্চয়পত্র। পাঁচ বছর মেয়াদী এই সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখন এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই হার সাড়ে ৯ শতাংশ।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। নতুন নিয়মে যাদের এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে সাড়ে ৯ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সেটি এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। এই সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ৩০ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ৯ শতাংশ হারে। অবসরভোগীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে এত দিন ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যেত। এখন এই সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ১৫ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে এই হার হবে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সাধারণ হিসাবে বর্তমানে মুনাফার সাড়ে ৭ শতাংশ, এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদি হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।