বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকটের সময়ে ইসলামিক বন্ড নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালেই সুকক নিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। বর্তমানে ইসলামি শরীয়াহ মোতাবেক সুকুক বন্ডের বিনিয়োগে কর ছাড় দেয়াসহ নানা সুবিধা প্রদান করতে যাচ্ছে সরকার।
উৎসে কর অব্যাহতি দেয়া হবে
শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি বন্ড সুকুক-এ বিনিয়োগকে উৎসাহ যোগাতে আরও একটি কর সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এবার এই বন্ডের বিনিয়োগ উৎসে কর অব্যাহতি পেতে যাচ্ছে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে এনবিআর সুকুকের অর্থ বিনিয়োগের উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) অব্যাহতি দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড ও ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উৎস কর দিতে হয় না। কিন্তু সুকুক বন্ডে ৫ শতাংশ উৎসে কর আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগ
সুকুক তথা একটি কার্যকর বন্ড বাজার গড়ে তোলার জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকার করে বিশেষ যে তহবিল গঠন করার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সেই তহবিলের অর্থ সুকুকেও বিনিয়োগ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। চলতি সপ্তাহে-ই বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
মোট ৮ হাজার কোটি টাকার সুকুক বাজারে
বাংলাদেশ ব্যাংক ৪ হাজার কোটি টাকা করে দুই দফায় মোট ৮ হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড নামে সার্টিফিকেট বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করছে। বিপরীতে তারা মুনাফা পাবে। সুকুক একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে সিলমোহর লাগিয়ে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেওয়ার আইনি দলিল। এখন সরকারের অর্থ সংগ্রহের নতুন একটি উৎস হয়েছে এ সুকুক।
উল্লেখ, সুকুক হচ্ছে ইসলামী শরীয়াহসম্মত বন্ড। মুসলিম বিশ্বে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে এই বন্ডের যথেষ্ট অবদান আছে বলে বিভিন্ন গবেষণা উঠে এসেছে। এই বন্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ মূলত অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।
পুঁজিবাজারেরও আসছে সুকুক
দেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড প্রথমবারের মতো সুকুক ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। কোম্পানিটি সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানী ও পরিবেশবান্ধব শিল্পে বিনিয়োগ করা হবে।
ইসলামি বন্ড সুকুক কীভাবে চলবে
বিনিয়োগকারীদের টাকায় গড়ে উঠবে এই প্রকল্প। সরকার এই প্রকল্প ভাড়া নেবে। এই ভাড়ার টাকা থেকে মুনাফা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। আর মেয়াদ শেষে পুরো প্রকল্প কিনে বিনিয়োগকারীদের মূল টাকা ফেরত দেবে সরকার। এভাবে প্রথম এ বন্ডের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
বিনিয়োগকারীদের জন্যও সুবিধা
বর্তমানে ব্যাংকে মাত্র ২ শতাংশ মুনাফা পাচ্ছে আমানতকারীরা। কিন্তু এরই প্রেক্ষিতে সুকুকে ৪ শতাংশর বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। এছাড়া উৎসে কর অব্যাহতি দিলে এর পরিমান প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি যাবে। সব মিলিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্যও সুকক একটি বিশেষ ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে।
ড. মো. বখতিয়ার হোসেন বলেন, সঙ্কটের সময়, প্রচলিত বাজারগুলোর তুলনায় তুলনামূলকভাবে ভালো পারফরম্যান্স করেছে। সুতরাং ইসলামিক আর্থিক সম্পদগুলোর যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা প্রত্যাশিত। প্রচলিত আর্থিক বাজারে মুসলিম বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করার আগ্রহ থাকলেও, তারা তা করতে পারেনি। কারণ, শরিয়াহ্ আইন অনুযায়ী সুদ, জুয়া, ও ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরই প্রেক্ষিতে বলা যাচ্ছে যে দেশে সুকুকে বিনিয়োগ ভাল ফল বয়ে আনবে।
প্রচলিত বন্ড ও সুকুক-এর পার্থক্য
ঋণদাতা ও ঋণগ্রহিতার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিই হচ্ছে বন্ড। এতে ঋণের পরিমাণ, পরিশোধের সময় ও সুদের হার উল্লেখ থাকে। প্রচলিত বন্ডে সুদ, ফাটকা ইত্যাদি থাকায় তা শরিয়াহসম্মত নয়। আর সুকুক হচ্ছে এমন একটি বিনিয়োগ সনদ, যাতে সম্পদের ওপর মালিকানা দেওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। সাধারণত সুকুকধারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করেন এবং মুনাফা পান।
কেন সুকুক জনপ্রিয় করতে চায় সরকার?
অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অত্যন্ত বেশি। যা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আশা করা যায় না। এ কাজ করতে যে ঘাটতি অর্থায়ন করতে হয়, সরকার এতদিন তা করে আসছে প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা থেকে। অবশ্য গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছে সুকুক-এর কার্যক্রম।
জানা গেছে, পুরো ব্যাংক ব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারিত্ব প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোনও উপকরণ নেই। ফলে একদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর নিরাপদ এ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছে, অন্যদিকে সরকার তার ঘাটতি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না। ঘাটতি অর্থায়ন সুকুক-এর মাধ্যমে করা হলে সরকারের সুদের ব্যয়ও কমবে।