পরিবেশ দূষণে শুধু মাত্র স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বসবাসের অযোগ্যতা নয় বরং বিপুল পরিমাণের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে রাজধানীবাসী বেশি ভুক্তভোগী। বছরে বাংলাদেশের ৬৫০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয় দূষণের কারণে। যা বর্তমান মূল্যে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। নানা ধরনের দূষণ ও নেতিবাচক ইনডেক্সের কারণে বসবাসের অনুপযোগী অথবা নিকৃষ্টতম শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে ঢাকা শহর।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, দেশে প্রতিবছর যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এর ২৮ শতাংশেরই মৃত্যু হয়ে থাকে পরিবেশ দূষণের কারণে। পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে মৃত্যুর হারের তুলনায় বৈশ্বিক মৃত্যুর হার ১৬ শতাংশ। গ্রামের দিকে দূষণের মাত্রা তুলনামূলক কম হলেও, শহরাঞ্চল অতি উচ্চ মাত্রার দূষণের শিকার। বাংলাদেশের দূষণ নিয়ে ‘ইনহ্যান্সিং অপরচুনিটিজ ফর ক্লিন অ্যান্ড রেসিডেন্ট গ্রোথ ইন আরবান বাংলাদেশ, কান্ট্রি এনভারমেন্ট এনালাইসিস ২০১৮’ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে।
সিসায় শ্বাস নিচ্ছে মানুষ
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের বেশির ভাগেরই শহরের দরিদ্র এলাকায় বসবাস। শুধু সিসা দূষণ নয়, অন্যান্য দূষণের শিকার হচ্ছেন তারা।
বায়ুদূষণে চোখ, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়ে থাকে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, বায়ুতে রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ আছে এমন এলাকার মানুষের চোখ, নাক বা গলায় নানা ধরনের অসংক্রামক রোগ হয়ে থাকে। ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা অনেকাংশে দায়ী। ইটভাটায় পোড়ানো হয় নিম্নমানের কয়লা, কাঠ, টায়ার ইত্যাদি। ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে। বছরে প্রায় ২৩ বিলিয়নের বেশি ইট বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। জিডিপিতে ইটশিল্প প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখছে। বছরে প্রায় ২০৫ বিলিয়ন টাকা ইট উৎপাদনকারী কারখানাগুলো থেকে জিডিপিতে যোগ হচ্ছে। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ দেশের ইটখোলাগুলোয় কর্মরত; কিন্তু এই ইটভাটা থেকেই বায়ুদূষণ হচ্ছে।
তাছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর বায়ুদূষণের ১০.৪০ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহনের কালো ধোঁয়া।
প্রতিরোধে নানা উদ্যোগের পরামর্শ
ক্যাপসের পরিচালক ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বিআরটিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তরে আইনে বলা আছে শব্দদূষণরোধে পুলিশ যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে একথা আবার পুলিশের আইনে উল্লেখ নেই। পরিবেশের সার্বজনীন বিষয় নিয়ে কাজ করতে নৌপুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশের মতো পরিবেশ পুলিশ একান্তভাবে প্রয়োজন মনে করেন তিনি। তাহলে পরিবেশ পুলিশ দ্বারা পরিবেশের যে আইনগুলো আছে তার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হবে। যারা আইন মানবে না তাদের আইনের আওতায় এনে আনতে হবে। পরিবেশ পুলিশ ইউনিটের পাশাপাশি বিসিএসে এনভারমেন্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা পর্যায়ে যদি পরিবেশ ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া যায় তাহলেও পরিবেশ রক্ষায় বড়ও একটি ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে।
শব্দ দূষণও বাড়ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল। পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মানমাত্রা ১৩০ ডেসিবল ছাড়িয়ে গেছে। এত শব্দদূষণে একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। শব্দদূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে শব্দদূষণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও, তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। বিধিমালা অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা, সেই সাথে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয়। তবে সেই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বাংলাদেশের সর্বত্র সব ধরনের দূষণ সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে। দূষণের মাত্রা শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বায়ু, পানি ও শব্দসহ সব ধরনের দূষণ দেশবাসীর স্বার্থেই বন্ধ করার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ দূষণে আমরা সবাই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। পার্থক্যটা হচ্ছে, বিত্তশালীরা দূষণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুততার সাথে উন্নতমানের চিকিৎসা করিয়ে ফেলতে পারে, নিম্নবিত্তরা পারেন না; কিন্তু ক্ষতির হাত থেকে কারোরই রেহাই নেই। অতএব দূষণ নামক এই ভয়ঙ্কর দৈত্যকে রোধ করতে হবে। এ জন্য খুব বেশি অর্থ খরচের প্রয়োজন হয় না, শুধু মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পারলেই হবে। ইউরোপের অনেক দেশে দূষণ সহনীয় মাত্রায় রাখা হয়। তারা নাগরিকদের সচেতন করে দূষণ রোধ করেন। আমাদের নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াতে পারলেও আমরা দূষণ সহনীয় মাত্রায় রাখতে পারব। সচেতনতার বিকল্প নেই।