সালটা ১৯৬৩। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কিউবার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগে প্রায় ১২শ কিউবান সিগারেট কিনে স্টক করে রাখেন, যেন তার কিউবান সিগারেট খাওয়ায় ঘাটতি না হয়। তো প্রশ্ন হচ্ছে নিজে ব্যবহার করলেও ঠিক কী কারণে যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আর এই নিষেধাজ্ঞা আসলেই ঠিক কতটা কাজে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কি?
যুক্তরাষ্ট্র মূলত দুই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়। একটি হচ্ছে দেশের সাথে আমদানি-রপ্তানি কিংবা লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া। দ্বিতীয়টি নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বা সেবার আমদানি-রপ্তানি নিষিদ্ধ করা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমতি ছাড়া সেসব দেশের সাথে কোনো ব্যবসা করতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে তাদের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উপায় হিসেবে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে কাজে লাগায়। বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং কার্যকরের জন্য কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের আওতাধীন এই অফিসটি।
১৯৫০ সালে চীন যখন কোরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল গঠন করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সেসময় হ্যারি ট্রুম্যান যুক্তরাষ্ট্রে থাকা চীন ও কোরিয়ার সম্পদের লেনদেন আটকে দেয়।
ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, ২০টির বেশি দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে – মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, বেলারুশ, রাশিয়া, জিম্বাবুয়ে, সিরিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফরেন পলিসির এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে প্রথম বছরেই ৭৬৫টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে ১৭৩টি নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে।
যে সময় থেকে নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকে
বিভিন্ন দেশের ওপর নানা কারণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ সালে জিম্বাবুয়ের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা। জিম্বাবুয়ের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অবজ্ঞা করার অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। তবে রাষ্ট্র হিসেবে জিম্বাবুয়ের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি।
ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কিউবার ওপর ১৯৬৩ সাল থেকেই আমেরিকার নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যার মধ্যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা অন্যতম। এরপর ২০০০ সালে সে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করে কিউবাতে চিকিৎসা সামগ্রী ও কৃষিজ পণ্য রপ্তানির অনুমতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
কিউবার সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করতে না পারে সেজন্য ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ল্যাটিন আমেরিকার আরেকটি দেশ ভেনিজুয়েলার ওপর আমেরিকার নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরই মধ্যে কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে দেশটির সরকারকে দুর্বল করার জন্য।
ইরানের ওপর ১৯৭৯ সাল থেকে আমেরিকার আরোপিত নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দশকের পর দশক নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকার কারণে ইরান পরিস্থিতির সাথে অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
উত্তর কোরিয়ার ওপর আমেরিকার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর ফলে উত্তর কোরিয়ার সাথে আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়।
নিষেধাজ্ঞা কতটা কাজে লাগে?
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা কতটা ফল দেয় সেটি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর গ্লোবাল ফোরকাস্টিং ডিরেক্টর আগাথি ডেমারাইস চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে বলেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা হয় দ্রুত কাজ করে, নয়তো কখনোই কাজ করে না।
মিস্ ডেমারাইস আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা। যদি ছোট অর্থনীতির দেশ হয় তাহলে দুটো বিষয় হতে পারে। তারা হয়তো দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের মতবিরোধ কমিয়ে আনতে পারে, নয়তো নিষেধাজ্ঞার নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ।
তাছাড়া অনেক দেশ আছে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যেসব দেশের সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি সেসব দেশে নিষেধাজ্ঞা বেশি কার্যকর হয়।
যেসব দেশের সাথে আমেরিকার তেমন কোন অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই সেসব দেশে নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কার্যকর হয় না। ঠিক আফগানিস্তানে যখন তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসে সেময় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তবে তালেবান সরকারের ব্যবসানীতি ও বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে উল্টো তারা ইতিবাচক অর্থনীতির দিকে আগায়।
সব মিলিয়ে বলা যাচ্ছে যে সব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল ও বিভিন্ন কারণে বাণিজ্য সম্পর্ক বেশি তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বেশি তীব্রতর প্রভাব ফেলে।