সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ রোববার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কেবল তার নিজের ২৪ বছরের প্রেসিডেন্সিই শেষ হয়নি, তাদের পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনেরও অবসান ঘটেছে। ২০০০ সালে আসাদ ক্ষমতায় আসার আগে তার প্রয়াত বাবা হাফিজ তিন দশক প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
ইতিমধ্যে দেশটিতে ইসলামপন্থি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির-আল শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।
বাশার আল-আসাদ এখন স্বপরিবারে রাশিয়ায় আছেন, সেখানে তাদের আশ্রয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
আসাদ কেন রাশিয়া পালালেন?
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল রাশিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে রাশিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। ২০১৫ সালে আসাদের সমর্থনে রাশিয়া আকাশপথে অভিযান শুরু করলে তা যুদ্ধে রূপ নেয়, যা আসাদ সরকারকে সুবিধা দেয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি পর্যবেক্ষক গ্রুপ জানিয়েছে, পরবর্তী ৯ বছরে রুশ সামরিক অভিযানে ৮ হাজার ৭০০ বেসামরিক নাগরিকসহ ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তবে নভেম্বরের শেষ দিকে সিরিয়ায় বিদ্রোহীরা আকস্মিক আক্রমণ শুরু করলে আসাদ সরকারের পাশে দাঁড়াতে পারেনি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়া রাশিয়া।
বিদ্রোহী বাহিনী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাদে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, আসাদ ও তার পরিবার মস্কোয় পৌঁছেছেন এবং ‘মানবিক কারণে’ তাদের আশ্রয় দেয়া হবে।
তবে আসাদের অবস্থান ও আশ্রয় চাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সোমবার বলেন, “আপনাদের বলার মতো কিছু নেই… এখনই। অবশ্য রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত (আশ্রয় প্রদান) দেয়া সম্ভব নয়। এটা তার সিদ্ধান্ত।”
বিবিসি লিখেছে, মস্কোর সঙ্গে আসাদের সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে নথিভুক্ত।
২০১৯ সালে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক তদন্তে দেখা যায়, গৃহযুদ্ধের সময় সিরিয়া থেকে কোটি কোটি ডলার সরাতে আসাদের পরিবার রাশিয়ার রাজধানীতে অন্তত ১৮টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে। আসাদের বড় ছেলে হাফেজ সেখানে পিএইচডি করছেন, তার অভিসন্ধর্ভ নিয়ে স্থানীয় সংবাদপত্র গেল সপ্তাহেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সিরিয়ায় নৈরাজ্যের মধ্যে সপ্তাহান্তে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, মস্কোর কর্মকর্তারা রাশিয়ার ঘাঁটি এবং কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষায় ‘সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধীদের’ সঙ্গে আলোচনা করছেন।
আসাদের স্ত্রী ও সন্তান কারা?
আসাদ বিয়ে করেছেন ব্রিটিশ-সিরিয়ার দ্বৈত নাগরিক আসমাকে, যিনি পশ্চিম লন্ডনে সিরীয় ঘরে জন্ম নেন ও সেখানে বেড়ে ওঠেন। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হওয়ার আগে তিনি লন্ডনে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
আসমা ২০০০ সালে পাকাপাকিভাবে সিরিয়ায় চলে যান এবং আসাদকে বিয়ে করেন। ওই সময় আসাদ তার বাবার স্থলাভিষিক্ত হন।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের ভিজিটিং ফেলো ড. নেসরিন আলরেফাই বিবিসিকে বলেন, আসমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট রয়েছে, তাই রাশিয়ার পরিবর্তে তিনি যুক্তরাজ্যে ফিরে যেতে পারেন।
“তবে তার বাবা ড. ফাওয়াজ আল-আখরাসের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তিনিও রাশিয়ায় আছেন বলে জানা যাচ্ছে।”
প্রতিবেশীদের বরাতে মেইল অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসমার বাবা একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মা সাহার অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক। তারা মেয়ে ও জামাতাকে ‘সান্ত্বনা’ দিতে মস্কোতে থাকতে চাইছেন।
২০২২ সালে কংগ্রেসে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসাদ পরিবারের বর্ধিত সম্পদের পরিমাণ ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার। অসংখ্য অ্যাকাউন্ট, আবাসন খাতে বিনিয়োগ, করপোরেশন এবং অফশোর ট্যাক্স হ্যাভেনে বিনিয়োগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ও লুকানো থাকায় সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ জানা কঠিন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসাদ ও আসমা সিরিয়ার বড় বড় অর্থনৈতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এসব খেলোয়াড়ের কোম্পানিগুলোর অবৈধ আয় পাচার করতে এবং সরকারি তহবিল বাড়াতে কাজে লাগানো হয়।
এতে আরও বলা হয়েছিল, সিরিয়ার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার যে কমিটি ছিল, তাতে আসমার প্রভাব ছিল। তিনি সেই সময় সিরিয়ার খাদ্য ও জ্বালানি ভর্তুকি, বাণিজ্য ও মুদ্রার মতো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতেন।
তিনি সিরিয়া ট্রাস্ট ফর ডেভেলপমেন্টের ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল পুনর্গঠনে বেশিরভাগ বিদেশি সহায়তা আসে ওই চ্যানেলে।
২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেছিলে, স্বামী ও পরিবারের সহায়তায় আসমা ‘সিরিয়ার অন্যতম কুখ্যাত যুদ্ধ মুনাফাখোরে’ পরিণত হয়েছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসমাকে ‘পরিবারের ব্যবসায়িক প্রধান’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সেই সঙ্গে তাকে আসাদের চাচাত ভাই রামি মাখলুফের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ‘অলিগার্ক’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
রামি সিরিয়ার অন্যতম ধনী ব্যক্তি, যিনি সোশাল মিডিয়ায় ভিডিও পোস্টে তার সঙ্গে বাজে আচরণ করার অভিযোগ তুলেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের পারিপারিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।
আসাদ কি বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন?
আসাদ পরিবারের পতনের পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, সিরীয়রা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে, যা ব্যাপক আকারে অবর্ণনীয় মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
এর মধ্যে রয়েছে “রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা, ব্যারেল বোমা এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের পাশাপাশি হত্যা, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং নির্মূল- যা মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য।”
আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ এবং অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অ্যাগনেস ক্যালামার্ড।
মঙ্গলবার সিরিয়ার ইসলামপন্থি বিদ্রোহী নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেন, রাজনৈতিক বন্দিদের নির্যাতনের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তার নাম প্রকাশ করা হবে।
তিনি বলেন, তার সিরিয়ান স্যালভেশন সরকার অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া কর্মকর্তাদের ফেরাতে চেষ্টা চালাবে।
২০১৩ সালে সিরিয়ায় প্রাণঘাতী রাসায়নিক হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আসাদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছেন তদন্তকারীরা।
বিবিসি লিখেছে, সন্দেহভাজন অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা থাকলে রাশিয়া তার নিজের নাগরিকদের প্রত্যর্পণ করে না। আসাদের রাশিয়া ছেড়ে এমন কোনো দেশ বা রাজ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, যেখান থেকে তাকে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো হতে পারে বা যেখানে কেউ তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনতে পারে।